শিবলী নোমান
আমার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় কেন আমি সমাজবিজ্ঞান পছন্দ করি, তাহলে সম্ভবত আমি বিষয় হিসেবে এর সবকিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতার কথাই বলবো। সমাজবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে আমার যে স্বল্প পড়ালেখা, তা থেকে আমার প্রধানতম শিক্ষা এই যে, একজন যত বড় পণ্ডিতই হোক না কেন, তার সকল কথা অকাট্য সত্য হতে পারে না। আবার একজন মানুষের বক্তব্যকে পুরোপুরি বাতিল করাও যায় না।
তো, সমাজবিজ্ঞান যদি এই কারণেই ভালো লেগে থাকে, তাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে তা বিড়ম্বনারও কারণ হতে পারে বৈকি! যেহেতু পেশা হিসেবে বর্তমানে সমাজবিজ্ঞানেরই একটি বিষয়ে শিক্ষকতা করছি, তাই সমাজবিজ্ঞানের এই দারুণ দিকটি প্রায়শই গলার কাঁটা হয়ে যায় আমার জন্য। আর এটি মূলত ঘটে থাকে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা মুখে যতই মুক্তচিন্তার বিকাশের কথা বলি না কেন, কিংবা যতই বলি মানুষকে ভাবার কথা, দিনশেষে পরীক্ষার খাতায় লেখার জন্য গৎবাঁধা উত্তর আমাদের সাজানো থাকে; তা নাহলে নানা সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলেই হয়তো, সে বিতর্ক আপাতত থাকুক।
এক্ষেত্রে বিড়ম্বনাটা হলো, প্রায়শই আমি কিছু উত্তরপত্র পাই যেখানে কোন একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর পড়ে ঐ বিষয়ে ভাবনার নতুন খোরাক পাওয়া যায়। এরূপ উত্তরগুলো অন্তত আমার দৃষ্টি এতটুকু প্রসারিত করতে সাহায্য করে যে, আমি বুঝতে পারি বিষয়টিকে হয়তো আমার বোঝাপড়ার বাইরে এভাবেও ভাবা যায়। কিন্তু যেহেতু আমাদের বিদ্যায়তনে উত্তর কী হবে তা ভেবে প্রশ্ন করাই রীতিসিদ্ধ, তাই প্রশ্নগুলোর নানামুখী উত্তরের পথ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে বন্ধ, কিংবা খুব বেশি হলে অত্যন্ত সরু। ফলে এ ধরণের উত্তরগুলো আমার মস্তিষ্ককে ভাবালেও দিনশেষে নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
কারণ, চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলোতে দুইজন পরীক্ষক থাকেন, তাদের দেয়া নম্বরের গড়ই হয় একজন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর। আবার দুই পরীক্ষকের দেয়া নম্বরের ভেতর বেশি পার্থক্য হলে সেই উত্তরপত্র আরো একজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করেন। অর্থাৎ, আমার মস্তিষ্কে দোলা দিতে পারলেই যদি হাত খুলে নম্বর দিয়ে দেই, সেক্ষেত্রে ঐ শিক্ষার্থীর লাভবান হওয়ার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাও থেকে যায় সমানভাবে।
আবার অনেক সময় দেখি, কোন একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরা দল বেধে ভুল লিখেছেন। এসব ক্ষেত্রে উত্তর পড়েই বুঝতে পারা যায় যে, শিক্ষার্থীরা প্রশ্নটির মূল ধারণার সাথে পরিচিত নন, বা ভুলভাবে পরিচিত। আর যখন অধিকাংশ শিক্ষার্থী উত্তর হিসেবে একই ভুল তথ্য লিখে দেন, তখন এটিই ধরে নিতে হয় যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক অনিচ্ছাবশত ও জানার সঙ্কট থেকেই শিক্ষার্থীদের ভুল তথ্য দিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, এই ভুলের জন্য যদি শিক্ষকের দায় থেকে থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রে নম্বর বণ্টন কীরূপ হবে? এক্ষেত্রেও কিন্তু দুই বা তিনজন পরীক্ষকের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো হবে যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাধিক পরীক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র মুল্যায়নের পক্ষের লোক।
ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরি বলেছিলেন, পড়ালেখা হতে হবে সংলাপভিত্তিক। অর্থাৎ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভেতর বিভিন্ন বিষয়ে মনখোলা সংলাপ থেকেই জ্ঞান তৈরি হবে। নিয়মিত বিরতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে এসব বিড়ম্বনায় পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবি, ফ্রেইরি সাহেবের কথাগুলো ভালো লেগেছিল!
স্যার, উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পার্থক্য টা অনেক বেশকম হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু আর যদি পার্থক্য টা অনেক বেশি হলে শিক্ষার্থীরা কিভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বিষয়টা বুঝতে পারিনি। দয়া করে জানাবেন….
উত্তরপত্র দুইজন শিক্ষক মূল্যায়ন করেন, দুইজনের প্রদত্ত নম্বরের গড় যা আসে তাই শিক্ষার্থী পান।
কিন্তু দুইজন শিক্ষকের প্রদত্ত নম্বরের ভেতর যদি পরীক্ষার মোট নম্বরের ২০ শতাংশের বেশি (বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এই হার পরিবর্তিত হতে পারে) ব্যবধান থাকে তাহলে তা পুনরায় আরেকজন শিক্ষককে দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়।
এক্ষেত্রে একটি খাতা ৩য় পরীক্ষকের কাছে গেলে ৩য় পরীক্ষকের প্রদত্ত নম্বরের সাথে বাকি দুই পরীক্ষকের ভেতর যার নম্বর কাছাকাছি, সেই দুইজনের প্রদত্ত নম্বরের গড় করা হয়, আর শিক্ষার্থী সে অনুযায়ী নম্বর পান।
অনেক সময় এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, পরীক্ষার খাতায় ২য় (বহিঃস্থ) ও ৩য় পরীক্ষকের নম্বর গড় হয়, ১ম পরীক্ষকের নম্বর আর কোন কাজে লাগে না। অর্থাৎ যিনি কোর্সটি সারা বছর পড়ালেন, তার মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর কোন কাজে লাগে না।
কিছুটা কি বুঝাতে পেরেছি?