শিবলী নোমান
ইউভাল নোয়াহ হারারি সম্পর্কে প্রথম শুনি তার বই স্যাপিয়েন্স প্রকাশের পর। পরিচিত মহলের অনেকেই বইটির প্রশংসা করেছেন। আমার স্যাপিয়েন্স পড়া হতে হতে হারারির পরের দুই বই ‘হোমো ডিউস’ ও ‘টুয়েন্টি ওয়ান লেসনস্ ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’-ও প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ স্যাপিয়েন্স পড়ার ক্ষেত্রে আমি সম্ভবত পিছিয়ে পড়াদের অন্তর্ভুক্ত। তবে স্যাপিয়েন্স বইটি আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। ৭০ হাজার বছর আগে কীভাবে নানা প্রজাতির মানুষের ভেতর থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স তথা আমরাই টিকে গেলাম কিংবা কীভাবেই বা এই পৃথিবী আসলে মানুষের পৃথিবীতে পরিণত হলো তার এক দারুণ ও ভিন্নরূপী ধারাবর্ণনা করেছেন হারারি তার এই বইতে।
পৃথিবী কিংবা মানুষের ইতিহাস বর্ণনার প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর বাইরে গিয়ে ৭০ হাজার বছর আগের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, ১২ হাজার বছর আগের কৃষি বিপ্লব ও ৫০০ বছর আগের বৈজ্ঞানিক বিল্পবের মাধ্যমে মানুষের ইতিহাস সাজিয়ে হারারি স্যাপিয়েন্সের অগ্রযাত্রার মূল বাঁকগুলো অনেকটাই নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয়। ফলে হারারির একটা প্রভাব নিশ্চিতভাবেই তাঁর পাঠকদের উপর পড়ার কথা ও তা দীর্ঘদিন বিদ্যমানও থাকার কথা। হাজার হাজার বছরের মানুষের ইতিহাস বা মানুষকে বোঝার জন্যে এই বইটি পড়া বেশ জরুরি। যদিও হারারির লেখনীর কিছু অংশ থেকে তার পশ্চিমমুখীনতা খুব সহজেই ধরা পড়ে।
তবে হারারির এই পশ্চিমমুখীনতা কি আসলে খুব বড় কোনো সমস্যা? হারারি যদি ইসরায়েল তথা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ না হতেন তাহলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে আলোচনারও কিছু থাকতো না। কারণ পশ্চিমের কয়জন তাত্ত্বিক আসলে পশ্চিম তথা ইউরোপের বাইরের বিশ্ব নিয়ে ভেবেছেন বা ভাবলেও প্রচলিত ধারণার বাইরে এসে ভাবার চেষ্টা করেছেন? সেই সংখ্যা খুব বেশি হওয়ার কথা না। আবার এ কথাও সত্য যে যদি ৫০০ বছর আগের যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে স্যাপিয়েন্সের মূল অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে বলে হারারি বলতে চাচ্ছেন, সেই বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা তো আসলে ইউরোপেরই অগ্রযাত্রা।
চার্চের কর্তৃত্ব থেকে বের হয়ে কিংবা উপনিবেশের গোড়াপত্তন কিংবা পুঁজিবাদের উত্থান, সবকিছুর পেছনে হারারির ভাষায় ছিল মানুষের ‘অজ্ঞতা আবিষ্কার’, প্রাচ্যের মানুষরা একে বলতে পারেন ইউরোপের মানুষের ‘অজ্ঞতা আবিষ্কার’। তাই সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রাকে ধরে মানুষের ইতিহাস বর্ণনা করতে হলে সম্ভবত হারারির ইউরোপকেন্দ্রিক হওয়া ছাড়া উপায়ও খুব বেশি ছিল না।
কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে যা যতটা সরল তা সম্ভবত ততটা সরল আদৌ নয়। তাই স্যাপিয়েন্স পড়ে হারারির ভূয়সী প্রশংসা করলেও হারারিকে ক্রিটিক্যালি পড়ার একটা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় দৃঢ়ভাবে। হারারির দ্বিতীয় বই হোমো ডিউস পড়ার পর তাকে ক্রিটিক্যালি ভাবা ছাড়া ছেড়ে দিলে আদতে কিছু বিপদের শঙ্কা হয়তো থেকে যায়। স্যাপিয়েন্সের বিষয়বস্তু ছিল ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড’ আর হোমো ডিউসের বিষয়বস্তু হলো ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টুমরো’। হোমো ডিউসের এই উপশিরোনাম থেকেই বুঝতে পারা যায় যে এই বইতে হারারি আসলে আলোচনা করতে চাচ্ছেন আগামী দিনগুলোতে আমাদের সাথে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে।
যেহেতু হারারি হোমো ডিউসে ভবিষ্যত সময়ের চিত্র আঁকতে চেয়েছেন, তাই বলতেই হয় যে এই বইয়ের অনেক কিছুই হয়তো হারারির এক ধরনের অনুমান, যা তিনি বর্তমান বাস্তবতা থেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। বইটির কোন কোন অংশে হারারি তা স্বীকার করেও নিয়েছেন, যা করাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বিপদ হলো, অতীত ও বর্তমানের আলোকে যে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বা শঙ্কা হারারি করছেন তাকে একেবারে নিষ্পাপ চিন্তা বা কল্পনা বলে ছেড়ে দিলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। তো হারারি আসলে কী বলেছেন? মোটাদাগে যদি হোমো ডিউসে হারারির উপসংহার বলতে হয় তাহলে বলতে হবে যে প্রাযুক্তিক উন্নয়নের একটি পর্যায়ে রক্তমাংসের মানুষের অনেক কাজই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে এবং ডাটা বা তথ্য হয়ে উঠবে আগামী দিনের ধর্মের মতো একটি বিষয়, কিংবা বলা যেতে পারে ডাটা বা তথ্যই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় সম্পদ।
এই উপসংহারে পৌঁছানোর আগে হারারি বলেছেন যে গত ৫০০ বছরে, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে মানুষ দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও যুদ্ধের মতো বিপর্যয়গুলোতে এখন আর আগের মতো ভুক্তভোগী নয়। স্যাপিয়েন্সেও তিনি যুদ্ধের ক্ষেত্রে একই আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু হারারি যে হিসাবে যুদ্ধ কমে যাওয়ার কথা বলেন, সেই হিসাব কিংবা তথ্য ত্রুটিপূর্ণ মনে হয় এই কারণে যে, আগে কতজন মানুষ যুদ্ধবিগ্রহে মারা গিয়েছে আর এখন কতজন মারা যাচ্ছে কিংবা যুদ্ধের পরিমাণ কমে যাওয়ার হিসাব দিয়ে যুদ্ধের বিচার করা যায় কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাওয়া স্বাভাবিক।
যাই হোক, এই দাবির পর হোমো ডিউসে হারারি বলছেন আগামী দিনগুলোতে মানুষ তিনটি বিষয় বা ক্ষমতা অর্জনের জন্যে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন। এগুলো হলো সুখ, অমরত্ব ও ঈশ্বরত্ব বা ঈশ্বরে পরিণত হওয়া। আর্থরাজনীতিক ও স্বাস্থ্যগত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রথম দুইটি ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হলেও মানুষ কিভাবে নিজেদের ঈশ্বরে পরিণত করবে?
হারারি বলতে চাচ্ছেন প্রাযুক্তিক উন্নয়নের কারণে মানুষের কাছে আগামী দিনগুলোতে এমন সব ক্ষমতা থাকবে যার কারণে প্রতিটি মানুষ আসলে ঈশ্বরের মতোই ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে। আর সামষ্টিক পর্যাতে ডাটা বা তথ্য এই কাজটি করে দেবে। তিনি বলতে চাচ্ছেন মানুষের সম্পর্কে যত বেশি তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে এক জায়গায় জমা করে রাখা যাবে, তত সহজ হবে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, নিরাপত্তাপ্রদান ও স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা। এক্ষেত্রে তিনি কেন্দ্রীয় কোনো প্রশাসনের কাছে আপনার–আমার সব তথ্য দিয়ে নিশ্চিন্তে জীবন পার করার পক্ষপাতী ও আমাদেরকে তাই হতে বলেন।
হারারি যেসব সুবিধা বা ক্ষমতার কথা বলেছেন তার সবই হয়তো আমরা অনেকেই চাই, কিন্তু নিজের একান্ত গোপনীয়তা আরেকজনের হাতে তুলে দিয়ে এটা চাই কিনা তা নিয়ে আসলে ভাবার আছে। যদিও আমাদের হাতে হাতে থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গুগল ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলো ইতোমধ্যেই আমাদেরকে আমাদের চেয়েও বেশি জেনে ফেলেছে ও প্রতিনিয়ত আরো বেশি করে জেনে নিয়ে তার মুনাফা বৃদ্ধি করছে। অর্থাৎ পুঁজিবাদের মুনাফা গোটাকয়েক কোম্পানি আর কর্পোরেশনের হাতে জমা হচ্ছে। তবে হারারি যেভাবে তথ্য দিতে বলছেন তার ভেতর স্বপ্রণোদিত হওয়ার একটা ব্যাপার আছে, যা সম্ভবত এই গুগলগোষ্ঠির ক্ষেত্রে আমরা হচ্ছি না। কিন্তু হারারি তাঁর হোমো ডিউসে পাঠকদের যে পিথে যেতে বলেন সেখানে একচেটিয়া পুঁজিবাদের জয়জয়কার ছাড়া খুব বেশি কিছু আদৌ দেখা যায় না। তার ওপর হারারি বলতে চাচ্ছেন যে পশ্চিমা মানবতাবাদ যেখানে প্রায় ৫০০ বছর ধরে মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রমের কেন্দ্রীয় চিন্তার বিষয় হিসেবে আবর্তিত হয়ে এসেছে, সেগুলো আসলে মানুষের মস্তিষ্কের কিছু ইলেক্ট্রনের কম্পন ছাড়া তেমন কিছু নয়। তিনি জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছেন মানুষ সামনের দিনগুলোতে বুঝে যাবে আত্মা, সততা, নৈতিকতা আসলে তেমন কোন অস্তিত্বশীল বিষয় নয়।
সমস্যাটা হচ্ছে, হারারিকে পুরোপুরি বাতিল করা সম্ভব নয়। হারারি দারুণ দারুণ সত্য তথ্যের ভেতর সূক্ষ্মভাবে এমন সব বিষয়ের পক্ষে কথা বলেন যার ফলাফল হিসেবে মানুষের নিজেদের ভেতরের সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা, গোপনীয়তা, আবেগ কমে যাবে কিন্তু বৃদ্ধি পাবে নিরাপত্তা, কেটে যাবে রোগ–শোকে মৃত্যুর ভয় কিংবা পাওয়া যাবে অমরত্ব। কিন্তু এই অমরত্বের জন্যে জীবনের যে দর্শন ত্যাগ করার দিকে হারারি আমাদের সূক্ষ্মভাবে ইঙ্গিত দিয়ে যান, সেদিকে যদি আমরা এগিয়ে যাই, তাহলে যে জীবন মানুষের জন্যে অপেক্ষা করে আছে, তা কি আদৌ মানুষের জীবন হতে যাচ্ছে? নাকি এতক্ষণ যা বলা হলো সেগুলোই আসলে সেকেলে কথা?
(রচনাকাল: আগস্ট, ২০২০)