শিবলী নোমান
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর যখন টুইন টাওয়ার হিসেবে পরিচিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে হামলা করা হল, তখন সেই ঘটনার ফলাফল বা প্রভাব কোনটা বোঝার মত বয়স আমার ছিল না। মনে আছে সেই দিনই আমি একটি প্রকৃত ‘ব্রেকিং নিউজ’ প্রচার হতে দেখেছিলাম কোন এক বাংলাদেশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। গণমাধ্যম অধ্যয়নে বলা হয় ব্রেকিং নিউজ হল সেই সংবাদ যা সাধারণত কয়েক বছরের ভিতর একবারও ঘটে না। এই হামলার ঘটনাটি ছিল সেরকম একটি ঘটনা। মনে আছে কোন এক অনুষ্ঠানের মাঝে শুধু এই সংবাদটি প্রচারের জন্যে সংবাদ উপস্থাপক হঠাৎ করেই সংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এবং সংবাদটি প্রচার করেই আবার আগের অনুষ্ঠানে ফিরে গিয়েছিল চ্যানেলটি। বিশ্ব রাজনীতিতে এই ঘটনার প্রভাব কেমন হতে পারে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও এই ঘটনাই ছিল পরের দুই-তিনদিনে স্কুলে বন্ধুদের আলোচনার বিষয়।
১৯৮০-র দশকে মিখাইল গর্বাচেভের ‘গ্লাস্তনাস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রয়িকা’-র তোপে যখন ১৯৯১ সালে চূড়ান্তভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলো তখন থেকেই আলোচনার বিষয় ছিল এর পরে কী? সোভিয়েত পতনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিতে পরিণত হলেও তার এই একক ক্ষমতা আরো বেশি সমুন্নত করতেই তার প্রয়োজন হবে আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বীর। অন্যদিকে স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’-এ সে সময়ই বলে দিলেন ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলো হবে সভ্যতার সাথে সভ্যতার। মজার বিষয় হল সভ্যতাগুলোকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে হান্টিংটনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ধর্মপরিচয়। যার ফলেই তিনি বলেছিলেন ক্যাথলিক ক্রোয়েশিয়া আর অর্থডক্স সার্বিয়ার ভিতর সংঘাত থেকে যাবেই। জানি না মার্কিন নীতি-নির্ধারকগণ ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন পড়েই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কিনা। সেটি হোক বা না হোক তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নিলেন ইসলাম ধর্মকে। যদিও তাদের ভাষায় এটি ‘ওয়ার অন টেরর’। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হল যে নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের বিশ্ব সংবাদ নির্মাণের পঞ্চম ফিল্টার ‘অ্যান্টি-কমিউনিজম’ এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে গেলো ‘অ্যান্টি-টেরোরিজম’।
তবে একথা এক বাক্যে স্বীকার করতে হয় যে, ৯/১১-র সেই ঘটনার পর বৈশ্বিক দৃশ্যপট এমনভাবে বদলে গিয়েছে যা কখনোই কল্পনা করা সম্ভব হয় নি। এই ঘটনায় এক সময় রোনাল্ড রিগান ও মার্কিন মদদপুষ্ট তালিবান ও আল-কায়দা নেতা উসামা বিন লাদেনকেই সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে আফগানিস্তানে হামলার ক্ষেত্র তৈরি করলো মার্কিন সরকার। সারা পৃথিবীর মানুষ যেখানে সহজেই বুঝতে পারলো এই যুদ্ধ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নয় বরং তেলের জন্যে, সেখানে বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আফগানিস্তানে শুরু হল মার্কিন আগ্রাসন। জর্জ ডব্লিউ বুশের সেই দাম্ভিক উক্তি ভুলে যাবার নয় যেখানে তিনি বলেছিলেন বিশ্ববাসীকে আজ ঠিক করতে হবে তারা বুশের পক্ষে থাকবেন নাকি সন্ত্রাসবাদের পক্ষে। অল্প সময়ের ভিতর আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের সরকার বসালো মার্কিনীরা। কিন্তু এত সহজেই যদি প্রতিদ্বিন্দ্বী হেরে যায় তাহলে তো নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করা হবে না। তাই চাই প্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্ববাসীকে নিয়মিত দেখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা। তাই এবার নিশানা হল সাদ্দাম হোসেন। আশির দশকে আট বছর ব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট বন্ধু সাদ্দাম হোসেন মার্কিনীদের দ্বারাই অভিযুক্ত হলেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের অভিযোগে। তাই এবার বিশ্ব জনমত ও জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে মঞ্চস্থ হল ইঙ্গ-মার্কিন জোটের ইরাক আগ্রাসন। সম্প্রতি প্রকাশিত চিলকট রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে যে টনি ব্লেয়ার চাইলেই এই যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু এড়িয়ে গেলে আসলে ইঙ্গ-মার্কিন জোটেরই ক্ষতি হত তা বলাই বাহুল্য। যেই আইএস-এর উত্থানে এখনো মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন জোট তাদের সামরিক হস্তক্ষেপ জারি রাখতে পেরেছে তার শুরুটা নিহিত ছিল এই ইরাক আগ্রাসনের ভিতরই। ইরাকের ক্যাম্প বুকাকে কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুন্নী বন্দীদের একটি ট্রেনিং ক্যাম্পে পরিণত করেছিল তা প্রকাশিত হয়েছে। কিভাবে ইরাকের সকল সুন্নী বন্দীদের মার্কিনীরা নিজেদের কাছে রেখেছিল এবং ইরাক ছাড়ার আগে তাদেরকে ইরাকি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর না করে মুক্ত করে দিয়েছিল তা প্রকাশিত হয়েছে। আইএস-এর আজকের উত্থানের কারণ হিসেবে ইরাকে সাদ্দাম প্রশাসনের পতনের পর ব্যাপক হারে সুন্নী সৈনিকদের চাকরিচ্যুত করার কথা এখন বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে সেটি ছিল ভুল পদক্ষেপ, এর চেয়ে তাদের ব্যবহার করা উচিত ছিল সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু তাদেরকে সুযোগ করে দিলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারতো?
এর ভিতর মুয়াম্মের বায়োজ্জি নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যে আগুনের সূত্রপাত করলেন তিউনিসিয়ায়, আরব বসন্ত নামে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়লো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়। কিন্তু সেই বসন্তের ফলও নিয়ে গেলো মার্কিন প্রশাসন। লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা করে গাদ্দাফির পতন ত্বরান্বিত করা হল, সেই লিবিয়া আজ জাতিবিদ্বেষে জর্জরিত। মিশরে জেঁকে বসেছে সেনাশাসন। অথচ মুদ্রার অপর পিঠে মার্কিন মিত্র সৌদি আরব বা বাহরাইনে জনগণের আন্দোলন যখন সরকার নির্মমভাবে দমিয়ে দিল তখন মার্কিনীদের বলার কিছু নেই। তবে কিছুটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে সিরিয়ায়। বাশার আল আসাদকে সরানো যেমন মার্কিন স্বার্থে জরুরি তেমনি বাশার আল আসাদকে টিকিয়ে রাখা রাশিয়ার জন্যে জরুরি। ফলে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে নতুন করে জেগে ওঠা রাশিয়ার সাথে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের শুরু। কিন্তু নব্য এই স্নায়ুযুদ্ধের ফলে সিরিয়ায় যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে সেই যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষের তান্ডবে যখন আইলান কুর্দি কিংবা ওমরান দাকনিশদের দেখা মিলে তখন আমাদের তাদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু যখন একের পর এক সমৃদ্ধ শহরগুলো ধ্বংস হল, মানবতা বিপর্যস্ত হল, সর্বোপরি মানুষের প্রাণহানি চলছেই তার কোন চিন্তা কি কখনো বা কোন কালে বৃহৎ শক্তিগুলোর ছিল?
৯/১১ নিয়ে অনেক কথা চলমান আছে। কেউ বলে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাজানো ঘটনা, কেউ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর দ্বারা আক্রান্ত। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সুফলভোগী। এর ফলেই মার্কিন প্রশাসন সোভিয়েত ইউনিয়নবিহীন এক মেরুর বিশ্বে আবারো নিজের প্রভাব বলয় তৈরির প্রয়াস পেয়েছে এবং তা কার্যকর করে চলেছে। তাই দেড় দশক পর যখন ৯/১১ নিয়ে কথা বলতে হয়, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে ধ্বসে পড়া টুইন টাওয়ার, তাতে আটকে পড়া মানুষ; ভেসে উঠে আফগানিস্তান বা ইরাকের পাহাড় বা রাস্তায় বোমা বা আত্মঘাতি হামলায় নিহত বেসামরিক মানুষের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মরদেহ; দেখা যায় ওমরান দাকনিশের বিষন্ন কিন্তু ঘৃণার্ত চোখ কিংবা পৃথিবীকে মুখ দেখাতে না চাওয়া আইলান কুর্দির ছোট শরীর। ৯/১১ এমন এক ঘটনা যার ফলে নির্ধারিত হয়েছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের নির্মমতা। ৯/১১ তাই বিশ্ব মানবতার ট্র্যাজিক উপাখ্যান, যার শেষ কোথায় কেউ জানে না!