শিবলী নোমান

সাংবাদিক নিরাপত্তার নানা দিক

শিবলী নোমান

সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ তথা এই ভূখন্ডের প্রেক্ষিতে আলোচনা করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অষ্টাদশ শতকে। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর হাত ধরে যখন থেকে এই উপমহাদেশে সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু, তখন থেকেই আসলে সাংবাদিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়। হিকির এই বেঙ্গল গেজেটে যখনই ইংরেজ শাসন কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করে কোন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তখনই হিকির এই গেজেট বা স্বয়ং হিকির উপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হিকি বা হিকির বেঙ্গল গেজেট কোনটিই এই উপমহাদেশে থাকতে পারে নি। বরং হিকির গেজেটে প্রকাশিত সংবাদ ও তথ্যকে উপলক্ষ্য করে পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রগুলোকে বিধিনিষেধে ফেলার জন্য একের পর এক কালো আইন প্রণীত হয়েছে সমগ্র ব্রিটিশ শাসনামল জুড়েই। এর ভেতর ফাইভ রেগুলেশনস, ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, সেডিশন অ্যাক্টের মতো আইনসমূহ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ শাসকদের ভেতর শুধুমাত্র চার্লস ম্যাটকাফেই সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাঁর আগে-পরের কোন শাসকই তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেন নি বরং সংবাদপত্রকে এক ধরনের প্রতিযোগী হিসেবেই বিবেচনা করেছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেছেন।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে, সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার কথা বলে কেন সংবাদপত্রের উপর নেমে আসা দমন-পীড়ন বা চাপসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে। এর উত্তর হিসেবে বলা যেতে পারে যে, সবার আগে চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত করতে হবে যে এখানে ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি দ্বারা কী ধরনের নিরাপত্তাকে নির্দেশ করা হচ্ছে। এখানে ‘নিরাপত্তা’ কি শুধুমাত্র দুর্বৃত্তের হামলা থেকে নিরাপত্তা? আমার মনে হয় না। অন্তত আমি মনে করি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বা অনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় শুধুমাত্র একটি দিক নয় বরং অন্তত তিনটি আলাদা দিক আছে। প্রতিটি দিক নিয়েই আলোচনা করা হবে। তার আগে প্রাথমিক আলোচনায় আবারও ফিরে যাওয়া যাক।

পাকিস্তান আমলেও কিন্তু আমরা দেখেছি নানা সময় নানা ধরনের আইন-অধ্যাদেশ জারি করে সংবাদপত্রগুলোর কন্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া সামরিক শাসনের সময় প্রকাশ্যেই সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনা-কর্তৃপক্ষ নিয়মিত সংবাদপত্রগুলোকে প্রেস-অ্যাডভাইজ দিয়েছে। একই কাজ করেছে ১/১১ পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

এটি স্পষ্ট যে, আমি এই ধরনের চাপকেও সাংবাদিক নিরাপত্তার আলোচ্য ইস্যু হিসেবে মনে করি। আরও মনে করি যে, সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার চেয়ে সাংবাদিক অনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা বেশি জরুরি। কারণ অনিরাপত্তাগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই বিষয়গুলো বেশি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারে এবং এর ফলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত মাধ্যমিক আলোচনায় প্রবেশ করা সহজ হয়।

বলেছিলাম অন্তত তিন ধরনের নিরাপত্তা বা অনিরাপত্তার দিক আছে বলে মনে করি। এই দিকগুলো হলো,

  • চাকরিজনিত অনিরাপত্তা
  • আর্থিক অনিরাপত্তা
  • পেশাগত অনিরাপত্তা

আমরা মূলত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে পেশাগত কাজ করার সময় তারা যেসব অনিরাপত্তার সম্মুখীন হন তা নিয়েই আলোচনা করে থাকি। এ বিষয়েই সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে আলোচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমি মনে করি তারও আগে সাংবাদিকদের চাকরিজনিত ও আর্থিক অনিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। কারণ এই দুই ধরনের অনিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের সাংবাদিক মহল কখনোই একটি সৃজনশীল শ্রেণিতে পরিণত হতে পারবে না।

১। চাকরিজনিত অনিরাপত্তা

বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের অর্থায়নে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, দেশের সাংবাদিকদের ৯২ শতাংশ মনে করেন যে তাদের চাকরির নিরাপত্তা নেই। এছাড়া ৫৭ শতাংশ সাংবাদিক কাজ করেন অতিরিক্ত চাপ নিয়ে। এই গবেষণায়,

…ঢাকা শহরের ১৫টি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে কাজ করেন; যার ৯টি বাংলা ও ৬টি ইংরেজি। এছাড়া ২১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, দুটি বেসরকারি এফ এম রেডিও চ্যানেল, ৪টি অনলাইন সংবাদ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মোট ৪২টি সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে গবেষণা করেন সাইফুল আলম। তথ্য সংগ্রহের জন্য ৩৩৪ জন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ সাংবাদিক স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী… ৩৩৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৩০৭ জন অর্থাৎ ৯২ শতাংশ মনে করেন সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা নেই।  তাঁরা জানান, যেকোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে, আর চাকরি চলে গেলে অভিযোগ করার মতো সুযোগ নেই। টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের মধ্যে এ নেতিবাচক ধারণা সবচেয়ে বেশি। (এনটিভিবিডি, ২০১৮)

উপরোক্ত গবেষণা থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার একটি সাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে বলা হয়েছে যে, টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সবচেয়ে বেশি। সৌভাগ্য হোক বা দুর্ভাগ্য, আমার বাংলাদেশের দুইটি টেলিভিশিন চ্যানেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর আমার অভিজ্ঞতার সাথে এই গবেষণার ফলাফল পুরোপুরি মিলে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংবাদকর্মী বা সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। একজন দক্ষ সাংবাদিকও নিশ্চয়তা দিয়ে আজকে বলতে পারবেন না যে আগামীকাল কর্মস্থলে গিয়ে তিনি শুনবেন না যে অনিবার্য কারণে তার চাকরিটি আর নেই। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এই চিত্র বেসরকারি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতেই দেখা যায়।

গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই চাকরিজনিত অনিরাপত্তার আবার দুইটি ধরন রয়েছে। প্রথমটি হলো ব্যক্তিগত অনিরাপত্তা। এটি নিয়ে আসলে আলোচনা করা হয়ে গিয়েছে। একজন সাংবাদিক সবসময়ই জানেন যে তার চাকরিটি যে কোন সময় চলে যেতে পারে। সেটি হতে পারে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে কিংবা সাংবাদিকের কোন ছোট বা বড় ভুলের কারণে কিংবা অদৃশ্য কোন চাপের কারণে।

এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধরনটি খুবই মারাত্মক, সেটি হলো কর্মস্থলের বা হাউজের বা প্রতিষ্ঠানের অনিরাপত্তা। বিভিন্ন সময় আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম হাউজকে বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছি। বছরখানেক আগে একদম আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় সকালের খবর নামে একটি দৈনিক সংবাদপত্র। অর্থাৎ এক রাতের ব্যবধানে একট সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল সাংবাদিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন। তাহলে এ ধরনের অনিরাপত্তা কি অনিরাপত্তা নয়? জীবিকার প্রশ্নে অনিরাপত্তা নিয়ে একজন সাংবাদিক কতক্ষণ শতভাগ নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সাথে কাজ করে যেতে পারবেন? এক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো আমাদের গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতির। আমাদের দেশে বেসরকারি গণমাধ্যমের সংখ্যাগত বিকাশ হয়েছে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাত ধরে। একের পর এক সংবাদপত্র, টেলিভিশিন, রেডিও চ্যানেল চালু হয়েছে ব্যবসায়িক গ্রুপের মালিকানায়। ফলে গণমাধ্যম গণমানুষের মাধ্যম নয় বরং মুনাফাবৃদ্ধি ও নিজের ব্যবসায়িক অবস্থান ধরে রাখার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এরই ফলাফল হিসেবে গণমাধ্যমকর্মীরাও তাদের প্রতিষ্ঠানের হতে পারে নি। এক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদেরও বিবেচনা করা হচ্ছে মুনাফাবৃদ্ধির হাতিয়ার বা নিতান্ত শ্রমিক হিসেবেই। আর এজন্যেই একজন বা প্রতিষ্ঠানের সবার চাকরি থাকলো কি থকলো না তা নিয়ে চিন্তার কোন অবকাশ আমাদের গণমাধ্যমগুলোর নেই।

২। আর্থিক অনিরাপত্তা

বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের উপরোক্ত গবেষণাটিতেই সাংবাদিকদের আর্থিক অনিরাপত্তার দিকটি উঠে এসেছে। এই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, ৩১ শতাংশ সাংবাদিক মনে করেন যে তারা যে বেতনভাতা পান তা দিয়ে জীবন কাটানো বেশ কঠিন। একই সংখ্যার সংবাদকর্মী মনে করেন যে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের বেতনভাতা অনেক কম।

আমাদের দেশে সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তথা স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যখন গণমাধ্যমে কাজ করতে আসেন তখন তিনি সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা বেতনভাতা পান (ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। বর্তমান সময়ে ঢাকা শহরের মতো এলাকায় এই টাকায় পুরো মাস কখনো চলা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে থাকা প্রতিনিধি ও সংবাদকর্মীদের বেতনভাতার কথা নাই বা বললাম। আর এই কারণেই ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা একাধিক হাউজের হয়ে কাজ করতে বাধ্য হন, অনেক সময় অবলম্বন করেন অনৈতিক ও অবৈধ পন্থা। এসব সমস্যার কথা বলে সাংবাদিকদের এসব অনৈতিক বা অবৈধ কর্মকান্ডকে বৈধ করা চেষ্টা করা হচ্ছে না কোনভাবেই, শুধুমাত্র মুদ্রার অপর পিঠটা দেখানো হচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করেও বাংলাদেশের নবীন সংবাদকর্মীরা যে বেতনভাতা পান, অনেক ‘অড জবস’ করেও তার চেয়ে বেশি মাসিক আয় করা সম্ভব হয় এদেশেই। এর ফলে দক্ষ সংবাদকর্মীরা দেশের গণমাধ্যমে কাজ করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। এছাড়া অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বেতনভাতাও দেয়া হয় না, সংবাদকর্মীদের জীবন থাকে আর্থিক অনিশ্চয়তায় ঘেরা। মাসের পর মাস বেতনভাতা না পেয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হন তারা। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তথা পুরো দেশ।

৩। পেশাগত অনিরাপত্তা

আমার মনে হয় সাংবাদিকদের পেশাগত অনিরাপত্তা নিয়েই আলোচনা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আমরা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বলতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টিকেই বুঝে থাকি। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থাও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও কি আমাদের সংবাদকর্মীরা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই এই বিষয়টি একটি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফ্রি প্রেস আনলিমিটেডের পরিচালক লিও উইলেমস বলেছেন,

গড়ে প্রতি পাঁচ দিনে একজন সাংবাদিক পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শুধু সাংবাদিক হওয়ার জন্য খুন হচ্ছেন। ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টিরই বিচার হয় না। এতে যে বিচারহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়, তা কেবল মৃত্যুর হুমকি ও সহিংসতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাংবাদিকদের কারান্তরীণ করার হার এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কাজের সময় সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে হয়রানি ও ভয় দেখানো হয়। আজ পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় সাংবাদিকতা বিপজ্জনক পেশার অন্যতম। (মানবকন্ঠ, ২০১৮)

এছাড়া নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়,

বিশ্বজুড়ে চলতি বছর সাংবাদিক খুনের হার বেড়েছে। যুদ্ধ ও সংঘাতের ঝুঁকি কমে আসা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা আরো বেশি হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে…এক বছর আগের তুলনায় ২০১৮ সালে প্রায় দ্বিগুণ সাংবাদিক পেশাগত কারণে প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার হয়েছে। (ইত্তেফাক, ২০১৮)

প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ৮০ জন ব্লগার, সিটিজেন জার্নালিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী খুন হয়েছেন।

ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগি ইস্যুতেও কম আলোচনা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় কিভাবে একজন সাংবাদিকের উপর প্রতিশোধ নেয়া হতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ জামাল খাশোগি হত্যাকান্ড। মিয়ানমারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় সরকারের রোষানলে পড়া রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সোয়েওর বিচার কার্যক্রম নিয়েও আমরা অবগত আছি।

আমাদের দেশেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ফলে বিভিন্ন সময় সংবাদকর্মীরা হামলা-হয়রানি এমনকি হত্যার শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখায় অন্তত ১৩ জন সাংবাদিককে শহীদ হতে হয়েছে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ফলে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলনের নামে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাংবাদিকদের উপর হামলা করা হয়েছে বিভিন্ন সময়।

চিহ্নিত সমস্যার সমাধান কোথায়?

যেসব অনিরাপত্তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে তা কম-বেশি দেশের সাংবাদিক মহলের জানা। অর্থাৎ সাংবাদিকদের নিরাপত্তাবিধানে যেসব অন্তরায় রয়েছে তা চিহ্নিত অবস্থায়ই রয়েছে। এখন প্রয়োজন সমাধান। সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফ্রি প্রেস আনলিমিটেডের পরিচালক লিও উইলেমস সমাধান হিসেবে প্রকাশ্যে আলোচনার কথা বলেছেন (মানবকন্ঠ, ২০১৮)। এ বিষয়ে আমিও একমত পোষণ করি। আমাদের সাংবাদিকদের ভেতর চাকরির ও আর্থিক যে অনিরাপত্তা সর্বদা বিদ্যমান তা নিয়ে আলোচনা থাকলেও তা ফলপ্রসূ আলোচনা নয়। একই পর্যায়ে থাকা দুই বা ততোধিক সংবাদকর্মীর ভেতর এসব অনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় কোন সমাধান আসার সম্ভাবনা নেই। বরং এই আলোচনাগুলো গণমাধ্যমের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।

এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে অবস্থার ইতিবাচক উত্তরণ সম্ভব। সরকারের উদ্যোগেই সাংবাদিকদের অষ্টম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর হয়েছিল। তবে দেশের সকল সংবাদপত্র এই ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতনভাতা প্রদান করে নি। এ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিওতে কর্মরত সাংবাদিকদের বেতনভাতার বিষয়ে কোন নীতিমালা নেই। যাকে যত কম বেতনভাতা দিয়ে নিয়োগ দেয়া যায় তাই দেয়া হচ্ছে। ফলে এই খাতে এক ধরনের অরাজকতা রয়েছে। এই অবস্থার উত্তরণেও সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

আইন করে সাংবাদিকদের চাকরিজনিত ও আর্থিক নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব হলেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় তাদের যে অনিরাপত্তা সৃষ্টি হয় তা থেকে উত্তরণে আসলে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। বিশ্বব্যাপী সংবাদকর্মীর পেশাটিকে অনেক দেশের সরকারই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করে। শুধু সরকার নয় বরং রাজনৈতিক দলগুলোও নানা কারণে গণমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তাদের বিভিন্ন আন্দোলনে সংবাদকর্মীরা রোষানলে পড়েন। এক্ষেত্রে আমাদের অডিয়েন্স এবং সাধারণ মানুষকে এই নৈতিক শিক্ষাটি প্রদান করতে হবে যে, আর সব পেশার মতো সাংবাদিকতাও একটি পেশা যেখানে সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সংবাদকর্মী তার দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র। মুদ্রার অপর পিঠ হিসেবে সংবাদকর্মীদেরও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে এই কারণে যে, যেন তাদের কোন অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের ফলে দেশের সামগ্রিক সাংবাদিক মহলের প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি না হয়।

দিনশেষে সাংবাদিক নিরাপত্তার বিষয়টি আসলে নিশ্চিতিভাবে বলা যায় না। সাংবাদিকতা বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর অন্যতম। বিশ্বের কোন দেশের সরকার নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে না যে তার দেশে সাংবাদিকরা শতভাগ নিরাপদ। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এই বাস্তবতায় থেকেই যতটা সম্ভব সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, সাংবাদিকদের চাকরিজনিত, আর্থিক ও পেশাগত নিরাপত্তা বিধান করতে পারলেই দেশের গণমাধ্যম খাতটি এগিয়ে যাবে, ফলাফল হিসেবে লাভবান হবে বাংলাদেশ, প্রিয় মাতৃভূমি।

 

(রচনাকাল: ডিসেম্বর, ২০১৮)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।