শিবলী নোমান
ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাসদপত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি নামক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারীর মাধ্যমে। ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার বা হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট নামে পরিচিত এই সংবাদপত্রটির জীবনকাল খুব বেশি দীর্ঘ হতে পারে নি, কারণ আধেয় হিসেবে যে বিষয়গুলোকে হিকি তার পত্রিকায় স্থান দিয়েছিলেন সেগুলো মূলত ছিল কোম্পানির নানা পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্বেষ, দাম্পত্য কলহ, পরকীয়ার ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। এসব আধেয়র ভেতর সে সময়ের গভর্নর জেনারেলকে নিয়ে নানা ধরনের চটকদার তথ্য প্রকাশও বাদ পড়ে নি। আর এসব তথ্য প্রকাশের নিশ্চিত পরিণতি হিসেবে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়ে হিকি সাহেবকে ফিরে যেতে হয়েছিল নিজ মাতৃভূমি যুক্তরাজ্যে।
এই উপমহাদেশে গত ২৪১ বছরে সংবাদপত্রের পথ-পরিক্রমা নানা উত্থান-পতনের আখ্যান। এর ভেতর একদিকে যেমন রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক পত্রিকা প্রকাশ, অন্যদিকে তেমনি ছিল উপনিবেশিত জনগণের কাছে উপনিবেশের জন্য স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়া বন্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে একের পর এক কালাকানুন তৈরি ও তার প্রয়োগ তথা দমন-পীড়ন।
তবে এটা নিশ্চিত যে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আবহ ও জীবনচর্চাকে আকার দিতে কিংবা তাকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো দারুণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা হোক কিংবা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত নতুন উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্বারা হোক বা হোক রক্ষণশীল সমাজের সদস্যদের দ্বারা, সমাজে নতুন কোন চর্চার সামাজিকীকরণ কিংবা নতুন কোন চর্চার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য অথবা জনগণের নির্দিষ্ট অংশের ভেতর অন্য যে কোন ধরনের পরিবর্তন আনয়নে প্রভাবকের স্থানে বিদ্যায়তনিক সাময়িকী বা জার্নালগুলোর সাথে সাথে ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব না হলেও, এটি বলা খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না যে, সেই সময়ে সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকাকে একটি দেশে গণমাধ্যমের চতুর্থ স্তম্ভের ভূমিকা পালনের মতোই মনে করা যেতে পারে। এই অবস্থায় উদ্ভূত প্রশ্নটি হলো, স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অর্ধশতাব্দীকাল পরে এসে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের পথ-পরিক্রমা ও ভবিষ্যত কেমন দেখা যাচ্ছে?
বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ নিয়ে কথা বলতে গেলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা কোন না কোনভাবে খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে সামনে চলে আসে। আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও বিভিন্ন সংবাদপত্র বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে গণমাধ্যম হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমান প্রভাব সম্ভবত অন্য কোন সংবাদপত্রের পক্ষে বিস্তার করা সম্ভব হয় নি, মূলত সঙ্গত কারণেই তা সম্ভবও ছিল না। কারণ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ঐ সময়ের প্রভাবশালী দৈনিকগুলো সেই সময় অবরুদ্ধ ও দখলকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী দ্বারা কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তবে সে সময় সীমান্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অনেকগুলো পত্রিকা প্রকাশের তথ্য গণমাধ্যম ও ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায়।
এছাড়া অনেকেই বলে থাকেন যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধটি ১৯৭১ সালে হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সেই আলোকে কথা বলতে গেলে আমরা এটিও দেখবো যে, গোটা পাকিস্তান আমল জুড়েই বিভিন্ন পত্রিকা সেই সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত গঠনে এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে ঐতিহাসিক ছয় দফা ও উদীয়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনোভাব ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছিল। আর এজন্যেই সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাককে বেশ কয়েকবার নিষিদ্ধ হতে যেমন দেখা গিয়েছে, একই সাথে এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে কারাবরণও করতে হয়েছে। তাছাড়া নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মসূচি প্রকাশের উপায় হিসেবে সেই সময়ের অনেক রাজনৈতিক দলই নিজেদের মুখপত্র হিসেবে সংবাদপত্র প্রকাশ করতো।
এই পরম্পরাকে ধরে রেখেই মুক্তিযুদ্ধের পর একদিকে যেমন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর মুখপত্র হিসেবে গণকণ্ঠ প্রকাশিত হতে থাকে, তেমনি আওয়ামী লীগের পক্ষের সংবাদপত্র হিসেবে বাংলার বাণীও উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব অর্জন করে, তাছাড়া বাংলা ও ইংরেজি অন্যান্য দৈনিক ও অন্য ধরনের সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন তো ছিলই। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী কঠিন সময়গুলোতে, বিশেষত চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষপীড়িত কুড়িগ্রামের চিলমাড়ির বাসন্তীর মাছ ধরার জালকে শাড়ির মতো শরীরে পেচিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টার ঘটনা ছবিসহ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা নিয়ে যেমন আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একে দেশের ইতিহাসে হলুদ সাংবাদিকতার প্রথম উদাহরণ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়, তেমনি সেই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী পক্ষ এই ঘটনাকে বারংবার উল্লেখ করে ঐ সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধও করতে চান। তাছাড়া ঐ সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভিন্ন সংবাদপত্রে হয় অতিমাত্রায় সরকার বিরোধিতা বা সরকারি নীতির তোষণ দেখা যেত। সংবাদপত্রগুলোর এমন ব্যবহার এই সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করে যে, ঐ সময় পর্যন্ত আমাদের এখানে সংবাদপত্রগুলো ছিল অতিমাত্রায় পার্টিজান ও সেই কারণে অনেক বেশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ফলে একই ঘটনার কয়েক ধরনের বিবরণ ও কার্যকরণ ব্যাখ্যা হয়তো একই দিনের একেক পত্রিকায় একেক রকম হতো। এর ফলে এটি বলা যেতে পারে যে, ইতিহাসের এই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠতা অর্জনের পথে না গিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিরোধ বা রেজিস্ট্যান্সের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।
এরপরের প্রায় দেড় দশকের সামরিক শাসনের অধীনে আমাদের দেশের সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা হোঁচট খায়, যার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। এই সময়গুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে গণমাধ্যমগুলোর কাছে প্রেস অ্যাডভাইসের নামে আধেয় হিসেবে কী প্রকাশ করা যাবে আর কী প্রকাশ করা যাবে না, সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান।
যাই হোক, ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশে তথাকথিত গণতন্ত্র ফিরে আসলে দেশে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সূচিত হতে দেখা যায়। এসব পরিবর্তনের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, গণতন্ত্র ফিরে আসার মাধ্যমে জাতীয় ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ব্যতিরেকে অন্য যেসব ক্ষেত্রে নিয়মিত গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত ছিল, সেগুলোর চর্চা ব্যাহত হওয়া ও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাছাড়া এই সময় থেকেই সম্ভবত আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভেতর বিদ্যমান মতপার্থক্য নির্বিশেষে নব্য-উদারবাদী একচেটিয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে কাঙ্ক্ষিত ও অনুসরণীয় অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এর প্রভাব সংবাদপত্রের উপরও পড়েছে এবং খুব বাজেভাবে পড়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
বলা হয়ে থাকে যে, দেশে গণতন্ত্র ফেরার পর গত শতকের শেষ দশকে দেশের প্রিন্ট সাংবাদিকতা তথা সংবাদপত্র শিল্পে বিস্ফোরণ বা বুম হয়েছে; আর একুশ শতকের শূন্য দশক প্রত্যক্ষ করেছে ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের বিস্ফোরণ। এসব বিস্ফোরণের ফলে একের পর এক সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও মূলত ফ্রিকোয়েন্সি মড্যুলেশন বা এফ.এম. রেডিওর কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে এই বিস্ফোরণের ফলে আমাদের সংবাদপত্র বা বৃহৎ অর্থে গণমাধ্যম শিল্প হয়ে দাড়াতে পারলো কি? উত্তরটি নিঃসন্দেহেই নেতিবাচক, এই ক্ষেত্রটি আমাদের দেশে শিল্প হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। কিন্তু কেন?
আমরা যদি একটু ভাবি তাহলে দেখতে পাবো যে, আমাদের এই অঞ্চলের বিশিষ্ট সাহিত্যিকগণ কোন না কোন সময় বা এখনো সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন বা আছেন। এক্ষেত্রে মূলত তারা সংবাদপত্রগুলোর সাথে যুক্ত থেকেই সাংবাদিকতা করেছেন, চালিয়ে গেছেন তাঁদের সাহিত্যচর্চা। একই সাথে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আন্দোলন সংগঠন থেকে শুরু করে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও জনমত গঠনের কাজটিও তাঁরা করেছেন। অর্থাৎ এটি এক ধরনের প্যারাডক্স যে, রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজম হিসেবে সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করা প্রজন্মই আজকের তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চেয়ে মানসম্মত আধেয় সরবরাহ করেছে দীর্ঘকাল।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গত ৩০ বছরে যে বিস্ফোরণ দেখা দিয়েছে সেখানে মূলত সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা দখল করে নিয়েছে আমাদের দেশের বড় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়িক গ্রুপকে তটস্থ রাখার জন্য কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়িক গ্রুপের সাথে মিডিয়া যুদ্ধ চালাতেই এসব ব্যবসায়িক গোষ্ঠী নিজেদের সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম তৈরি করেছে। তাছাড়া নিজেদের ব্যবসায়িক দুর্নীতিকে ঢেকে রাখার ঢাল হিসেবে যেমন তারা এসব গণমাধ্যম ব্যবহার করছে, তেমনি সার্বিকভাবে বিজ্ঞাপনই এখন পর্যন্ত সংবাদপত্রের রাজস্ব আদায়ের প্রধানতম হাতিয়ার হওয়ায়, এসব ব্যবসায়িক গ্রুপ তাদের সংবাদপত্রে অন্যান্য বৃহৎ কর্পোরেট মুঘলদের বিজ্ঞাপন ধরে রাখতে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির খবরও অহরহ সেন্সর করে যাচ্ছে। তাছাড়া এর সাথে যুক্ত হয় আমাদের মতো দেশগুলোর বাস্তবতা হিসেবে গণমাধ্যমের উপর আরোপিত নানা ধরনের সরকারি, বেসরকারি ও কর্পোরেট চাপ, সেন্সর ও সেলফ সেন্সরশিপ। এই ব্যপারগুলো নিয়ে খুব বেশি প্রকাশ্য উদাহরণ দেয়া বিভিন্ন সঙ্গত কারণেই সম্ভব না হলেও, আগ্রহী পাঠক তাদের পরিচিত গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে দুই-এক দফা আলাপেই এ বিষয়ে ধারণা পেয়ে যাবেন বলে আশা করা যায়।
এই যখন বাস্তবতা তখন স্বাভাবিকভাবেই সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের আধেয়তে এক ধরনের শূন্যস্থান তৈরি হয়। হিসাব করলে নিশ্চিতভাবেই দেখা যাবে, আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে বর্তমান সময়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তুলনামূলকভাবে অনেক কম প্রকাশিত হচ্ছে। আর এর ফলে সংবাদপত্র ভরে উঠছে দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনা ও আনুষ্ঠানিকতার সংবাদ দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই সংবাদকর্মীরাও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ পাচ্ছেন না। পাশাপাশি সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো যখন নিজেদের অনিয়মকে ঢেকে রাখার উদ্দেশ্য থেকে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আসে, তখন এই ক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথাও থাকে না। বরং এসব ব্যবসায়িক গ্রুপ যদি আগামীকাল দেখে যে তার আর সংবাদপত্রের প্রয়োজন নেই আর এর চেয়ে আলু-পটলের ব্যবসা এই মুহূর্তে লাভজনক; তাহলে নিশ্চিত থাকুন এক রাতের ভেতর ঐ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে এসব মালিক শ্রেণি দ্বিতীয়বার ভাববে না। এমন পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানে যত কম পারিশ্রমিক দিয়ে সাংবাদিক নিয়োগ সম্ভব, তাই করা হচ্ছে। ফলে সাংবাদিকতার রোমাঞ্চ যেমন একদিকে হারিয়ে গিয়েছে, তেমনি থাকছে না সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বস্তি। ফলে আমাদের এখানে আসলে থাকছে না কোন প্রকৃত সাংবাদিকতা।
দেশের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনলাইন গণমাধ্যমের উত্থান। যদিও গণমাধ্যম সংক্রান্ত বিদ্যায়তনিক এলাকায় এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে যে, অনলাইন গণমাধ্যমের উত্থানের ফলে প্রিন্ট বা ছাপা কাগজের সংবাদপত্র আসলেই বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে কি না। তবে অনলাইন মাধ্যমের কারণে প্রচলিত সংবাদপত্রে এক ধরনের পরিবর্তন ও অস্বস্তি যে তৈরি হয়েছে, তা প্রায় নিশ্চিত। যেহেতু বিজ্ঞাপনই গণমাধ্যমগুলোর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস, সেই হিসাবে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্স (ওয়ান-ইফরা)-র প্রতিবেদনগুলোতে, প্রিন্ট সংবাদপত্র থেকেই সিংহভাগ রাজস্ব আদায় হলেও অনলাইন থেকে রাজস্ব প্রাপ্তির হারে নিয়মিত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর দিনশেষে যেহেতু সংবাদপত্র প্রকাশনাও এক ধরনের ব্যবসাই, তাই অনলাইন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন তথা রাজস্ব সরে গেলে সংবাদপত্রগুলোকে হয়তো অনলাইনেই মূল মনোযোগ দিতে হবে।
সংবাদপত্রসহ বাংলাদেশের অন্যান্য গণমাধ্যম ইতোমধ্যেই অনলাইন বা ডিজিটাল প্লাটফর্মে তাদের কর্মকাণ্ডকে সম্প্রসারিত করেছে। এর অংশ হিসেবে মূলধারার গণমাধ্যমের নিয়মিত আধেয়র পাশাপাশি অনলাইনবান্ধব নতুন নতুন আধেয়ও তারা নিয়মিত তৈরি করে প্রকাশ করছে। মূলত মূল কার্যক্রমের সাথে অনলাইন পোর্টাল, ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মতো সামাজক মাধ্যমে নিজস্ব অ্যাকাউন্ট ও ইউটিউব চ্যানেলে নিয়মিত আধেয় প্রকাশ করে তারা অনলাইন মাধ্যমের অডিয়েন্সকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। একই সাথে প্রিন্ট সংবাদপত্রের মাধ্যমে অর্জিত রাজস্বের যে ঘাটতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে অর্জিত রাজস্ব দিয়ে তা পূরণের চেষ্টাও তারা করে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে প্রিন্ট বা ছাপা কাগজের সংবাদপত্র নিয়ে কোন ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করা আসলে খুবই মুশকিলের একটি কাজ। কারণ গণমাধ্যম অধ্যয়নে মার্শাল ম্যাকলুহানের যে কোন অনুসারীই হয়ত বলবেন যে নতুন প্রযুক্তির উত্থানের ফলে মানুষ এখন এই নয়া মাধ্যমগুলোই ব্যবহার করে নতুনভাবে নিজেদের জীবনকে আকার দিবে আর তাই পুরনো মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র চলে যাবে বাতিলের খাতায়। কিন্তু তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়ামসের মাধ্যম তত্ত্বের অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই আগে খুঁজে দেখতে চাবেন যে কেন ও কিভাবে এসব প্রাযুক্তিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। তবে যাই হোক না কেন, দুইটি বিষয়ে আমাদের গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দেয়া এখন জরুরি হিসেবে সামনে চলে আসছে বলে বোধ হয়।
প্রথমত, সংবাদপত্র হোক বা অন্য যে কোন গণমাধ্যম, প্রকৃত সাংবাদিকতাকে ধরে রাখতে না পারলে প্রাযুক্তিক কারণেই হোক বা অডিয়েন্সের অসন্তুষ্টি ও অতৃপ্তির কারণে হোক, এসব গণমাধ্যম তাদের জনপ্রিয়তা ও উপযোগিতা হারাবে। সেক্ষেত্রে পক্ষপাতহীনতা ও বস্তুনিষ্ঠতার বিকল্প নেই; কিন্তু আধুনিক প্রচারণার এই সময়ে এ ধরনের আদর্শিক অবস্থান গ্রহণ অনেকটাই ইউটোপিয় ধারণা মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্তত গণমানুষের জন্য সাংবাদিকতা জারি রাখা সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম শিল্পগুলোর নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই জরুরি।
দ্বিতীয়ত, প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ফলে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের উত্থানের সাথে সাথে নাগরিক সাংবাদিকতার সুযোগও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সময়ের সাথে সাথে এই নাগরিক সাংবাদিকতাও সাংবাদিকতার নানা ধরনের সিন্ডিকেট ও ফিল্টারে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে কিনা তা নিয়েও আলোচনা জরুরি। তবে আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে আধুনিক ডিভাইস ও ইন্টারনেট অসমভাবে হলেও ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু তার বিপরীতে শহুরে বা গ্রামাঞ্চল, কোন অংশের জন্যেই ডিজিটাল লিটারেসি ও মিডিয়া লিটারেসির কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আর এর ফলেই খুবই মানসম্পন্ন সংবাদপত্রের অনলাইন আধেয়গুলো পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত হিট-লাইক-কমেন্ট তথা রিঅ্যাকশন, আর তাই পিছিয়ে যাচ্ছে রাজস্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায়। অন্যদিকে, খুবই হালকা ও বাজারি আধেয় প্রকাশ করেও সাধারণ মানের গণমাধ্যম বা অ-গণমাধ্যমগুলো রাজস্ব নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূলধারার সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম, অন্যদিকে এসব বাজার চলতি গণমাধ্যম বা অ-গণমাধ্যমগুলোর জন্য গুজব, মিসইনফরমেশন ও ডিজইনফরমেশন ছড়িয়ে দেয়া হয়ে যাচ্ছে অনেক সহজ। আর সকল ক্ষেত্রেই এর ফলভোগ করতে হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকেই।
দিনশেষে তাই বলতে হয়, ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হিকির গেজেটের কলেবর, আকার, আধেয় ও পৃষ্ঠাসজ্জার বিপরীতে আজ ২০২১ সালে এসে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর কলেবর, আকার, আধেয় ও পৃষ্ঠাসজ্জায় এসেছে অনেক ধরনের পরিবর্তন। মূলত সংবাদপত্র বা যে কোন গণমাধ্যমই প্রকৃতির আর সব কিছুর মতোই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়। আর এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবেই হয়তো অনাগত বা সুদূর ভবিষ্যতে কাগজের সংবাদপত্রের বিলুপ্তি ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সাথে এই বোঝাপড়া জরুরি যে, কাগজের সংবাদপত্রই শুধুমাত্র সংবাদপত্র নয়, বরং অনলাইন মাধ্যমের সংবাদপত্রগুলোও আসলে ঐ একই জিনিস। আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলো বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও জনগণের অধিকার আদায়ে কিছুকাল আগে পর্যন্তও যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে, যে কোন মাধ্যম ব্যবহার করে দেশের আপামর জনগণের স্বার্থে সেই গণমুখী ভূমিকা পালন করে যাওয়ার ভেতরই সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের প্রকৃত দায় নিহিত, তা বুঝে নেয়া দেশের সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট সকল ও এর অডিয়েন্স, সবার জন্য সমান জরুরি।
(রচনাকাল: এপ্রিল, ২০২১)