শিবলী নোমান

স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অস্থির সময়ের বয়ান

শিবলী নোমান

১৯৬১ সালে উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ ফানোঁ লিখেছিলেন তাঁর বহুল আলোচিত বই দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ। পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিদ্যায়তনে উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়ন বা পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ নামে নতুন যে জ্ঞানকাণ্ড তৈরির প্রয়াস দেখা যায়, সেক্ষেত্রে অনেকে ফানোঁর উল্লিখিত বইটিকে চিহ্নিত করেন বিউনিবেশায়নের বাইবেল হিসেবে। আফ্রিকা মহাদেশের একটি ফরাসি উপনিবেশে বেড়ে ওঠা ফানোঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখিত বইটিকে কেন পৃথিবীর সকল উপনিবেশিত মানুষের বিউপনিবেশায়ন প্রয়াসের ক্ষেত্রে অবশ্যপাঠ্য বিবেচনা করা হয়েছিল, তা বুঝতে হলে দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ পড়া ছাড়া বিকল্প নেই, তা বলাই বাহুল্য। এই বইয়ের কোন কোন অধ্যায় পড়লে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন যে কোন মানুষের মনে হবে, ফানোঁর লেখনিতে তিনি বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ উপনিবেশিত ভারতে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডই দেখতে পাচ্ছেন। কিংবা আরেকটু গভীরে গিয়ে ভাবলে এটিও চোখে পড়বে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের এক দশক আগে রচিত বইটিতে ফানোঁ যেন বাংলাদেশেরই স্বাধীনতা উত্তর সময়ের ভবিতব্য লিখে রেখেছেন। অর্থাৎ একেবারে ভিন্ন একটি মহাদেশের মানুষ হয়েও উপনিবেশের ইতিহাস ও চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফানোঁকে মনে হবে একেবারে নিজের মানুষ, আর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের এরূপ সমরূপতার পেছনে কাজ করেছে তাদের সাধারণ ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা।

মূল আলোচ্য না হলেও ফানোঁর দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতের কারণ হলো, ফানোঁর রচনাগুলো যেখানে আমাদেরকে দেখিয়ে দিতে চায় যে উপনিবেশ থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি সাধারণত কোন্‌ পথে চালিত হয়, তার সাথে তাল রেখে এই লেখার আলোচ্য বইটি বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের মানুষকে যেন দেখাতে চেয়েছে তাদের স্বাধীনতার স্বরূপ, জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত বাস্তবতা। আর এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই ছোট ছোট লেখার মাধ্যমে উঠে এসেছে বদরুদ্দীন উমরের যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ শীর্ষক গ্রন্থে।

১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় উমরের যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ মূলত ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত সমকালীন বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধের একটি সংকলন। অসম্ভবকে সম্ভব করার এক দুর্বিনীত স্বপ্নকে পুঁজি করে একটি প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে উমরের লেখাগুলোকে স্রোতের বিপরীতে ভিন্নমতের বয়ানই বলতে হয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিনগুলোতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল জোয়ারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকে এসব প্রবন্ধে উমর যা যা বলেছেন, তার জন্য যে প্রখর বিশ্লেষণী ক্ষমতা, তাত্ত্বিক বোঝাপড়া এবং সর্বোপরি স্রোতের বিপরীতে থাকার অপার সাহস প্রয়োজন, সেটি যদি পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায়, তাহলে তা হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিধারা বোঝার ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে থেকে যাবে।

প্রায় দুই বছর সময়কাল জুড়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলো থেকে প্রথমেই যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তা হলো, উমর কি শুধুই তৎকালীন বাংলাদেশের সরকারের সমালোচনাই করেছেন, নাকি তিনি তাঁর বিশ্লেষণে ছিলেন নির্মোহ? এক্ষেত্রে বলতে হয়, নিশ্চিতভাবেই উমর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং সরকারের সাথে জোটবদ্ধ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর)-র তীব্র সমালোচক ছিলেন, এক্ষেত্রে তাঁকে একজন চাঁছাছোলা সমালোচক বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। আর এরই ফলশ্রুতিতে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), সংসদে থাকা অন্যান্য বিরোধী দল ও মওলানা ভাসানীর আন্দোলন কর্মসূচি ও রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।

কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে এটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি সেই সময়ের কোন রাজনৈতিক দলকেই, বা তাদের কোন কর্মসূচিকেই সমালোচনার উর্ধ্বে স্থান দেন নি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, একদিকে বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি যেমন সেই সময়ের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত ইউনিয়নের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পক্ষে থাকা মানুষের সমালোচনা করেছেন নিয়মিত, অন্যদিকে এসবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়া পিকিংপন্থি কমিউনিস্ট কর্মীদেরও তীব্র সমালোচনা করছেন স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার না করে স্বাধীনতা লাভের পরও এই ভৌগলিক এলাকাকে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে উল্লেখ করা জারি রাখার জন্য।

তবে আলোচ্য গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধে উমর তৎকালীন সরকার ও তার মিত্রদের বিভিন্ন সরকারি নীতি, কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এসব সমালোচনা শুধুমাত্র বাগাড়ম্বরে আবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও দর্শন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাস ও গতিধারার আলোকে বিবৃত হয়েছে। এসব প্রবন্ধে তিনি তৎকালীন সরকারের ধীরে ধীরে মার্কিনঘেঁষা হয়ে যাওয়ার দিকে যেমন নির্দেশ করেছেন, তেমনি সরকারের জাতীয়করণ নীতির ত্রুটিগুলোও দেখিয়ে দিয়েছেন একাধিক প্রবন্ধে। আবার বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বরূপকে তিনি যেভাবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়িত রূপ ও পূর্ব বাংলায় মুসলিম উঠতি বুর্জোয়াদের এজেন্ডার বাস্তবায়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, তা চিন্তার খোরাক জোগায় নিঃসন্দেহে। অন্যদিকে, বৃহৎ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে কেন তথাকথিত ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদ আসলে নানামুখী সঙ্কট ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি করে, এমন গভীর কিন্তু চিত্তাকর্ষক আলোচনার অবতাড়নাও দেখা যায় বিভিন্ন প্রবন্ধে।

যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ শীর্ষক গ্রন্থে স্থান পাওয়া উমরের প্রবন্ধগুলো পড়লে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হবে ১৯৭২-৭৪ সালে বদরুদ্দীন উমর যা লিখেছেন তার অনেক কিছুই পরবর্তী সময়ে যেমন বাস্তবে পরিণত হয়েছে, আবার অনেকগুলো বিষয় আমাদের সামনে এখনো ঘটছে প্রতিনিয়ত। অর্থাৎ, উমর যেন তাঁর লেখনিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের একটি অংশকে বন্দি করতে চেয়েছেন এবং কিছুটা হলেও সেই উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়েছেন।

এক্ষেত্রে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে আমরা মহিমান্বিত কিছু একটা হিসেবে দেখে ও বিবেচনা করে অভ্যস্ত। কিন্তু পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের বিভিন্ন গণআন্দোলনের ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে উমর বলতে চান, রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে সাধারণত সেই আন্দোলন বেহাত হয়ে যায়। ২০১১ সালের আরব বসন্ত কিংবা ২০১৩ সালে বাংলাদেশের গণজাগরণ মঞ্চের উদাহরণ আমাদের হাতের কাছেই তো আছে!

তবে গণমাধ্যমের শিক্ষার্থী হিসেবে এই বইয়ের যে বিষয়টি বর্তমান লেখকের কাছে বিশেষভাবে চোখে পড়েছে তা হলো বইটির ভূমিকায় উল্লেখ করা বদরুদ্দীন উমরের একটি মন্তব্য। কেন বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর এই ধরণের লেখাগুলো ১৯৭৪ সালের পর আর দৈনিক/সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হলো না সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করে তিনি লিখেছেন,

১৯৭৪ সালের জানুয়ারির পর থেকে বহুবিধ কারণে, যার মধ্যে প্রধান হলো এ ধরনের রচনা প্রকাশযোগ্য পত্রিকার জীবনাবসান, আমার পক্ষে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কোন দৈনিক অথবা সাপ্তাহিকে কিছু লেখা সম্ভবপর হয় নি।

যুদ্ধোত্তর বাঙালদেশ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে উমরের বক্তব্যকে পাঠক অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করতে পারলেও, আজ ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশের হাতে গোনা দুই-একটি জাতীয় দৈনিক ছাড়া অন্যান্য সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়/উপসম্পাদকীয়/কলামের বিষয়বস্তু, বয়ানের ধরণ ও তীক্ষ্ণতা দেখে এই বিষয়ে কি আমরা বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করতে পারি?

 

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।