শিবলী নোমান

ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলনে বিএনপি’র ভূত!

শিবলী নোমান

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ নিজেদের মতো আন্দোলনে থাকায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজ করছে স্থবিরতা। এরই মধ্যে এই দুই আন্দোলনেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি ভর করেছে বলে মন্তব্য করেছেন মন্ত্রীসহ সরকারি দলের কেউ কেউ। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি খুব সাধারণ প্রবণতা যে যখনই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে কোন গোষ্ঠী আপাতভাবে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে জনমত ও আন্দোলন তৈরি করতে চায়, তখনই প্রধান বিরোধী দলগুলো সেই আন্দোলনকে অন্ততপক্ষে নৈতিক সমর্থন দিয়ে নিজেদের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ২০০৬ সালের ফুলবাড়ী আন্দোলনের কথা। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এবং ফুলবাড়ীর স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লা খনন বিরোধী সেই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল সেই সময়ের বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ফুলবাড়ীর সংগ্রামী জনগণের উদ্দেশ্যে সেদিন সেল্যুটও জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট বা পিএসসি ২০০৮-এর বিরোধিতা করে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অংশ হিসেবে সেই জাতীয় কমিটিরই পেট্রোবাংলা ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ কর্তৃক লাঠিপেটা করে আহত করা হয়েছিল ফুলবাড়ী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ অনেককে। এই ঘটনার পর জাতীয় কমিটির ডাকা হরতালে বিএনপি যেমন নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল, আবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে থেকে যাওয়া বিএনপি’র ভূতের প্রভাবেই নাকি এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। এটি আসলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্যারাডক্স। তাই বর্তমানে চলমান ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন স্কিম বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন দেয়াটি যেমন তাদের সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক থাকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, একইসাথে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণও এই সমর্থন পাওয়ার জন্য মরিয়া বা সামান্যতম চিন্তিত, সেটিও বলার সুযোগ নেই।

তবে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের দায় আসলে অনেকাংশেই সরকারের উপর বর্তায়। এটি স্মরণযোগ্য যে, ২০১৮ সালে একই ধরনের আন্দোলনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীসমাজ চাকরিতে কোটা প্রথার বিলোপ চায় নি। তাদের আন্দোলনটি ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন, কোটা বিরোধী আন্দোলন নয়। কিন্তু আন্দোলনের এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সকল কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ফলেই আজকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সমাজকে আবারও কোটাবিরোধী আন্দোলনে নামতে হয়েছে।

তবে ০৭ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী এটি একদিক থেকে স্বস্তির খবর যে, শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। বিষয়টি এজন্যই স্বস্তির যে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা সংগঠিত আন্দোলন এখনো দেশে প্রতিরোধের একটি সংস্কৃতি জারি রাখতে পেরেছে, যা যে কোন সভ্য দেশের জন্য অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। একই সংবাদের আরেকটি তথ্য থেকে বিষাদের বিষয়টিও বলে রাখা ভালো, আর তা হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন সংক্রান্ত আন্দোলন নিয়ে সরকার এখন পর্যন্ত চিন্তিত নয়।

দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলেও সরকারের নিশ্চিন্ত থাকার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতিতে সরকারপন্থি শিক্ষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে। এর চেয়ে হতাশাজনক সত্যবচন এই প্রসঙ্গে আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। বিগত বছরগুলোতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে দলীয় লেজুড়বৃত্তির যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন এবং বুদ্ধিজীবিসুলভ আচরণ থেকে সরে গিয়ে যেভাবে রাজনীতিবিদসুলভ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন, তাতে গুটিকয়েক শিক্ষক সরকারের আস্থাভাজন হয়ে নানা পদ-পদবী হাসিল করতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষকদের সামগ্রিক স্বার্থ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে। শিক্ষকদের এহেন পদ-পদবী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দিকে লোভাতুর দৃষ্টির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তাব্যক্তিরা বর্তমানে ইউজিসি-র একের পর এক খামখেয়ালি ও উচ্চশিক্ষা ধ্বংসকারী সিদ্ধান্ত বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছে।

এমনকি, গত মার্চ মাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তকরণের ঘোষণা আসলেও শিক্ষক নেতারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যথেষ্ট গরিমসি করেছেন। এই মুহূর্তে শিক্ষকদের যে আন্দোলন চলছে, সেটি শুরু হওয়ার পেছনে মূলত সাধারণ শিক্ষকদের চাপ বড় ভূমিকা রেখেছে। যদিও এই আন্দোলনের ফলাফল নির্ভর করছে শিক্ষক নেতাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থার উপর। তবে আর কিছু না হোক, সরকার ও আমলাতন্ত্রের কাছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গুরুত্বহানির পেছনে শিক্ষক সমাজ যদি নিজেদের অন্ধ দলীয় রাজনীতিকে খুঁজে না পান, তাহলে দেশের সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য সামনে যে ঘোর কলিকাল অপেক্ষা করছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।