শিবলী নোমান
(এই লেখাটি ১৫ এপ্রিল, ২০২র তারিখে শিশিরের শব্দ ওয়েবম্যাগ-এ প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পুনরায় ১৫ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে লেখাটি এই সাইটে তোলা হয়।)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একাদশ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম নিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী এক প্রদর্শনী হয়ে গেলো গত ১৯ থেকে ২৩ মার্চ। প্রদর্শনীতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শিল্পকর্মের সাথে সাথে তাদের আঁকা ক্যারিকেচারও স্থান পায়। এরূপ তিনটি ক্যারিকেচারে দেখা মিলেছে বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ও একই দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালামের। শুধু দেখাই মিলে নি, বরং এই ক্যারিকেচারগুলোতে আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী ও আবদুল কালামকে যেসব রূপে ও কর্মে দেখা গিয়েছে, প্রদর্শনীতে আগত দর্শকদের জন্য তার বার্তা ও উপস্থাপন একদিকে ছিল খুবই চিত্তাকর্ষক, অন্যদিকে বিষয়গত অর্থের দিক থেকে এগুলোই আবার বহন করছিল গভীর সব অর্থ। ক্যারিকেচারে আমরা সাধারণত যেমনটা দেখে থাকি, ঠিক তাই।
তবে, শিল্প হিসেবে এসব ক্যারিকেচারের উপস্থাপন ও এসবের বার্তা নিয়ে আলোচনার সাথে সাথে অপর যে বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে তা হলো, বাংলদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের সমান বয়সী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন ক্যারিকেচার তৈরির জন্য ঐতিহাসিক বা পরিচিত চরিত্র হিসেবে দেশের কাউকে বেছে না নিয়ে আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী বা ডক্টর কালামকে বেছে নেন? আইনস্টাইন বা মহাত্মা গান্ধীর স্থলে যদি স্থানীয় তথা দেশীয় কোন চরিত্রকে দিয়ে ক্যারিকেচার সাজানো হতো, তাহলে কি প্রদর্শনীতে আগত দর্শকদের সাথে ক্যারিকেচারগুলোর যোগাযোগ আরো গভীর হতো না?
এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র দাসভি-র কথা বলা যেতে পারে। কারাগারে বন্দি থাকা এক সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমিক পরীক্ষার পড়ালেখার হালচাল দেখাতে গিয়ে এই চলচ্চিত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী চন্দ্রশেখর আজাদ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেকের যে হাস্যরসাত্মক উপস্থাপন করা হয়েছে, ভারতীয় চলচ্চিত্র বা শিল্পাঙ্গণে তা নতুন কিছু নয়। এরও আগে লাগে রাহো মুন্না ভাই (২০০৬) বা পিকে (২০১৪) চলচ্চিত্রেও আমরা মহাত্মা গান্ধীকে ফিরে আসতে দেখেছি নানান ভাবে নানান পরিস্থিতিতে, এছাড়া সুভাষ চন্দ্র বসুকে খুঁজে পাওয়া যাবে কোলকাতার ২০১১ সালের বাংলা চলচ্চিত্র আমি সুভাষ বলছি-তে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের আলাদা আলাদা বিষয় ও পরিস্থিতিতে দেশটির জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকদের এভাবে যুক্ত করার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের দর্শকদের সক্রিয় ও মনোযোগী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হওয়ার পাশাপাশি এই পন্থায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে দেশের বর্তমান নাগরিকদের এক ধরনের সংযোগও ঘটে থাকে।
অন্যদিকে, শেষ কবে আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় আমরা কোন রাজনৈতিক কার্টুন দেখেছি, তাও ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রথম পাতায় না দেখলে ভেতরের পাতায় কবে দেখেছি? আর যদি দেখেও থাকি, আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ ধরনের কার্টুন প্রকাশের পরিমাণ কি আগের মতো আছে? সম্ভবত নেই।
ক্যারিকেচার বা কার্টুন কিংবা রম্যরচনা, অর্থাৎ গুরুগাম্ভীর্যের দিক থেকে ‘হালকা’ ধাঁচের এসব শিল্প বা সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এই যে, এগুলোর মাধ্যমে সাম্প্রতিক বিষয়ে মজার ছলে, হালকা চালে অত্যন্ত গভীর ও তীক্ষ্ণ ভাব ও বার্তা প্রকশ করা যায়, যা আবার গণমানুষ খুব সহজেই ধরতে পারে এবং নিজেদের বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে নিতে পারে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে আমাদের ভেতর রাজনৈতিক সহনশীলতার যে অভাব, সেই অভাবই রাজনৈতিক অঙ্গনকে গ্রাস করে এখন শিল্প ও সাহিত্যের এলাকায় প্রবেশ করেছে বলেই সংখ্যার দিক থেকে রাজনৈতিক কার্টুন, ক্যারিকেচার ও রম্যরচনা কমে গিয়েছে। এ কারণেই নিজেদের দেশের শিল্পপ্রদর্শনীতে এখন আমাদের ধার করে আনতে হচ্ছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী কিংবা ডক্টর আবদুল কালামকে। তবে আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদের এছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে? আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাই নি শিশুর হাতে পরম মমতায় আঁকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি ব্যবহার করে সরকারি আমন্ত্রণপত্র তৈরির কারণে জাতির পিতার অবমাননার অভিযোগে মামলা দায়েরসহ কী কী কান্ড ঘটেছে কিছুদিন আগেও। শহীদুল জহিরের থেকে ধার করে এই অবস্থাকে বলাই যায় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।
তো, জনপরিসরে কার্টুন বা ক্যারিকেচারের মতো হাস্যরসাত্মক আধেয় কমে যাওয়ার ফলাফলকে এর আপাত সুবিধাভোগীরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, এর প্রভাব গভীর হতে বাধ্য। কার্টুন, ক্যারিকেচার বা রম্যরচনাকে যদি শাসক শ্রেণি বা শাসক গোষ্ঠীর আশেপাশের মানুষ শুধু নিজেদের সমালোচনা হিসেবেই নিয়ে থাকে, তাহলে সেই হিসেবে কিছুটা ভুল থেকে যায়। আমাদের দৈনন্দিন কষ্ট ও বেদনাকে কার্টুন ও রম্যরচনা যেভাবে ফুটিয়ে তোলে, তা দেখে আমরা কিছুটা হলেও হাসি-ঠাট্টার উপলক্ষ্য পাই, যা দিনশেষে আমাদের মন ভুলিয়ে রাখতেও সাহায্য করে বৈকি। অর্থাৎ এক অর্থে ও তর্কসাপেক্ষে এসব আধেয় সেই সব মানুষ বা গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করে, যাদের ব্যবহার করেই কিনা ঐসব আধেয়তে হাসি-তামাশার উপলক্ষ্য তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু যদি তা নাও হয়ে থাকে, তারপরও নানা পন্থায় বাস্তবতা নিয়ে মানুষের ভাবনার প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার প্রয়াস কি আদতে কখনো সফল হয়? সফল যদি হতোই, তাহলে কি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন নেতার আমলে জনগণের মুখে মুখে ফেরা কৌতুকগুলো কখনো তৈরি হতো? বা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে পারতো? এসব কৌতুকের বাংলা অনুবাদও হয়েছে, যা ১৯৯৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে সোভিয়েত্স্কি কৌতুকভ (১৯১৭-১৯৯১) নামে। অর্থাৎ, যতভাবেই চেষ্টা করা হোক না কেন, মানুষ তার অস্বস্তিকর অবস্থার বয়ান হিসেবে ব্যাঙ্গাত্মক প্রকাশভঙ্গিকে বেছে নিয়েছে বারংবার, তার প্রচার ও প্রসার ঘটুক বা না ঘটুক। এক্ষেত্রে সোভিয়েত্স্কি কৌতুকভ গ্রন্থের ভূমিকা অংশ থেকে স্মরণ করা যেতে পারে হাঙ্গেরির ব্যাঙ্গপত্রিকা হোসিপো-র সম্পাদক টিবোর ফারকাশের মন্তব্যটিকে, যেখানে তিনি বলছেন, “কৌতুক রচনা বা পরিবেশনের দায়ে হাজতবাসের আশঙ্কা থাকলে কৌতুক হয় অধিকতর সূক্ষ্ম ও ব্যাঙ্গাত্মক।”
অন্যদিকে, শিল্পচর্চা বা সমাজের অংশ হিসেবে কার্টুন, ক্যারিকেচার বা রম্যরচনার প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হলে অন্যান্য মাধ্যমে ও পন্থায় এমন সব আধেয় জায়গা দখল করে নেয়, যেখানে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর ইতিবাচক অর্জনগুলোর জন্যও জনমনে আর কোন জায়গা অবশিষ্ট থাকে না। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের চাপ ও ভীতি প্রদর্শনের ফলে এই যে আপাত শূন্যতা তৈরি, তার ফলও আদতে শাসক গোষ্ঠী নিজেদের ঘরে তুলতে পারে কদাচিত। বরং সাধারণ জনতা আর শাসকের বাইরে সুযোগ সন্ধানী অন্য কোন গোষ্ঠীই এই শূন্যতা থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি লাভবান হয়।
শূন্যতা তৈরি কিংবা বিদ্যায়তনিক ভাষায় এই সেন্সরশিপ বা সেলফ-সেন্সরশিপের ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোন উপকার হয়েছে, তা প্রমাণ করা যেমন দুষ্কর; তেমনি শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মানুষের সৃজনশীল বিচরণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারলেও তা থামানোও প্রায় অসম্ভব। এজন্যই ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে আমরা দেখা পাই সুবোধ-এর, কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত গ্রাফিতিতে ভরে যেতে থাকে আমাদের শহর ও ক্যাম্পাসের দেয়ালের পর দেয়াল, যা নাগরিক জীবনের অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা আর হতাশার দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ করা জারি রাখে, আশা দেখায় বুক ভরে শ্বাস নেয়ার।
এজন্যই, এর ভেতরও আমাদের তাই বলে যেতে হবে, “শত ফুল ফুটতে দাও।” এরই ভেতর আমাদের চিৎকার করে বলে যেতে হয়, শহর-নগরের দেয়ালে দেয়ালেই শুধু নয়, শত ফুল ফুটুক আমাদের পত্রিকগুলোর পাতায় পাতায়, কার্টুন বা ক্যারিকেচার কিংবা রম্যরচনা আকারে, শিল্পী-সাহিত্যিকের রঙ-তুলি-কলমে-পেন্সিলে।