শিবলী নোমান
(এই লেখাটি ২৮ জুলাই, ২০২৪ তারিখে সংবাদ প্রকাশ-এ প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পুইনরায় ২৯ জুলাই, ২০২৪ তারিখে লেখাটি এই সাইটে তোলা হয়।)
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ছড়িয়ে পরার পরপর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে সহিংস কর্মকাণ্ডের সাথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সম্পর্কহীনতার কথা জানানো হয়। একই সাথে শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক আন্দোলনকে অন্য কোন পক্ষের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পথ হতে দেয়া হবে না বলেও জানিয়েছিলেন তারা।
এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের প্রতি নিজেদের বিভিন্ন দাবির ভেতর কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী ও নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক, আইনি ও অ্যাকাডেমিক হয়রানি না করার দাবিও জানানো হয়েছিল। আইনমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল অনেকেই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের মামলা, নির্যাতন বা আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে না বলে জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এরই ভেতর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক তুলে নিয়ে যাওয়া ও হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শনিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন সমন্বয়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে কারণ দেখিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ নিয়ে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তাদের খোঁজে ১২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে গেলেও দায়িত্বশীল কেউ শিক্ষকদের সাথে কথা বলেন নি।
এই ঘটনায় শনিবার প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি থেকে জানা যায়, ঐ তিনজন সমন্বয়ককে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা ভয়ে কাঁপছিলেন। সেক্ষেত্রে গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদেরকে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিয়ে যাওয়া হলে তাদের ভয় পাওয়ার কারণ অবোধগম্য, আবার শিক্ষকদের সাথে কথা না বলাও সন্দেহের উদ্রেক করে।
এদিকে রবিবার ভোরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলসহ আন্দোলনের আরো কয়েকজন সমন্বয়ককে সিআইডি ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সহিংসতা ও নৈরাজ্যমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না থেকে শুধুমাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলন করার জন্য কোন শিক্ষার্থীকে আইনি হয়রানি করা হবে না।
সেই কথাটি যে রাখা হচ্ছে না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার একটি উদাহরণ হতে পারে। কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিলেন। ১৫ জুলাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হলে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা উপাচার্যের কাছে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছিলেন এবং বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন হলে পুলিশ ডাকার দাবিও করেছিলেন।
সেই রাতে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে যাওয়া শিক্ষকরা নির্যাতনের শিকার হন। এটি উল্লেখ করা জরুরি যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় স্থাপনাসমূহে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার বিপরীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি অহিংস পদ্ধতিতে তাদের আন্দোলনটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৫, ১৭ ও ২১ জুলাই আন্দোলনকারীদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে ও রেজিস্ট্রার ভবনে ভাঙচুর চালানো হলেও, আন্দোলনের সমন্বয়কদের বক্তব্য অনুযায়ী সমন্বয়ের দুর্বলতা ও আন্দোলনে অনুপ্রবেশের কারণেই ঘটনাগুলো ঘটতে পেরেছে। এই বিষয়গুলোকে সহিংসতা হিসেবে ধরা হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা ক্যাম্পাসের বাইরে কোন ধরনের সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর খবর পাওয়া যায় নি।
কিন্তু গত শুক্রবার প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ১৫ তারিখ রাতে উপাচার্য ভবনে হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার এজাহারে পুরো ঘটনার দায় এককভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর চাপানো হয়েছে। ফলে বিষয়টিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আইনি হয়রানি হিসেবেই দেখতে হচ্ছে। সমন্বয়কারী আরিফ সোহেলেকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর পৈত্রিক নিবাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের খোঁজ-খবর নেয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার দিকেই নির্দেশ করে।
এ ধরনের মামলা দায়ের ও সমন্বয়কদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হওয়ার বিকল্প নেই। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা চাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথও থাকে না, থাকার কথা না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকের মতাদর্শের মিল থাকা জরুরি কোন বিষয় নয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ না থাকলে, নিরাপত্তা বা অন্য যে কোন কারণে তাদের এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাই বলতেই হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, কথা রাখুন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিন।