মুজিব ভাই,
আপনি আসলে কেমন আছেন তা জানার কোন সুযোগ মানুষের নেই, গত ৪৯ বছর ধরেই নেই। তবে আপনার কথা ধার করে আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়েই আপনাকে লিখতে বসা। জীবনে সম্ভবত প্রথমবারের মতো আপনাকে বঙ্গবন্ধু সম্বোধন না করে মুজিব ভাই বলে সম্বোধন করলাম, তার কারণটাও উল্লেখ করবো দ্রুতই।
দিন দশেক আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে আপনার হাতে তৈরি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে। যে গণতন্ত্রের জন্য আপনি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দমন-পীড়নের মাঝে থেকে রাজনীতি করেছিলেন, আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, সেরকম কোন গণতান্ত্রিক উপায়ে এই পতন ঘটলে বলার কিছু থাকতো না। কিন্তু এই পতন ঘটেছে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে কে বা কারা ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে, সে সংক্রান্ত বহু ভাষ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব ভাষ্যের নির্মোহ যাচাইয়ের উপযুক্ত সময় আসতে এখনো বহু দেরি। কিন্তু ক্রীড়নক যদি থেকেও থাকে, এই গণঅভ্যুত্থানে দেশের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা একটি আন্দোলনকে সরকার যেভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে দমন করতে চেয়েছে, আর তারই অংশ হিসেবে দেশের ছাত্র-জনতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তারপর এসব তথ্য জানা কোন ব্যক্তির পক্ষে গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষে দাঁড়ানো কঠিন হওয়ার কথা। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল বছরের পর বছর বাক স্বাধীনতা হরণ ও বিরুদ্ধ মত দমনের নানা নৃশংস পন্থার অবলম্বন।
এসব কিছুর বিপরীতে আমার শুধু আপনার কথা ভেবেই খারাপ লাগা কাজ করে। যে দেশের মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য আপনি সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করলেন, সেই মানুষরাই সরকার পতনের পর সব জায়গা থেকে আপনার নামগুলো মুছে দিতে শুরু করলো। রাজধানীর বিজয় স্মরণীতে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার-এর নাম থেকে আপনার নামের অংশটি রঙ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে দেখলাম। পাশেই বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে আপনার নামের অংশটি ঢেকে রাখা হয়েছে। মিরপুর রোডে মুক্তিযুদ্ধের দেয়াল চিত্রে আপনার মুখটি রঙ করে দেয়া হয়েছে। এরকম আরো কতকিছু হয়েছে তার কোন হিসাব নেই।
কিন্তু কেন এমন হলো? ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুকুটবিহীন রাজার ন্যায় আপনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। সেই ধ্বংসপ্রায় রাষ্ট্রের নির্মাণ কাজে আপনার সরকার খুব ভালো করেছিল, বিদ্যমান রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সাহিত্যের আলোকে তেমনটা বলার সুযোগ খুব বেশি নেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে-পরে দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে যে শেখ মুজিবের জন্য একটা স্থান ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকার এক নম্বরে আপনার নামটি আসার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাহলে দেড় দশকের অধিক কাল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পর, কেন দেশের মানুষ এখন আপনার নাম-কথা-ছবি সহ্য করতে পারছে না? রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষনকারী ছাড়া বাকি মানুষের এমন মনোভাবের কারণ কী?
কারণ হলো আপনার হাতে গড়া দলটি গত দেড় দশকে আপনাকে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের নেতার আসন থেকে সরিয়ে দেবতায় পরিণত করতে সদাতৎপর থেকেছে, ঠিক যেমনটা বলেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। বিজয় স্মরণীর নভোথিয়েটারের নাম আদতে কী হওয়ার কথা ছিল সেই আলাপে না গিয়েই বলতে চাই, উদ্বোধনের সময় এর নামকরণ করা হয়েছিল ভাসানী নভোথিয়েটার হিসেবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর নামটি বদলে দেয়া হয়। অথচ মওলানা ভাসানীকে আপনি নিজে একসময় নেতা মেনেছেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাও তো তিনি-ই ছিলেন।
দেশে একের পর এক স্থাপনা, অবকাঠামো, পুরষ্কারের নামকরণ করা হয়েছে আপনার নামে। কিন্তু এই দেশের ইতিহাসে তো আরো বহু মানুষের নানামুখী অবদান ছিল, আছে, থাকবে। আমরা দেখলাম আপনাকে দেবতার আসনে বসাতে গিয়ে বাকি সবার অবদানকে ফিকে বা অদৃশ্য করে ফেলা হলো। পুরো বিষয়টিকে এক হাস্যকর প্রপঞ্চে পরিণত করা হলো। আমরা দেখলাম একাধিক জেলায় হুবহু একই নামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলো, আপনারই নামে। একটি শিশুর হাতে আঁকা আপনার মুখচ্ছবিকে আপনার অবমাননা হিসেবে চিহ্নিত করে মর্মাহত হওয়ার অজুহাতে এক সরকারি কর্মকর্তাকে হেনস্তা হতেও দেখা গেলো ২০১৭ সালে। এমনভাবে আইন করা হলো যেন আপনার কোন ন্যায্য সমালোচনাও কেউ করতে না পারে, অথচ আপনি বলেছিলেন ন্যায্য কথা বললে সংখ্যায় একজন হলেও তা মেনে নিবেন।
অর্থাৎ, আমাদের চারপাশে আপনাকে স্থাপন করা হয়েছিল সর্বত্র বিদ্যমান সত্তা হিসেবে, অথচ মানুষের হৃদয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর কোন খোঁজ করা হয় নি। চিঠির শুরুতে বলেছিলাম এই প্রথম আপনাকে মুজিব ভাই হিসেবে সম্বোধন করছি। এর কারণ হলো আপনাকে কেন বঙ্গবন্ধু বলা হয় নি, অথবা নামের আগে জাতির পিতা উল্লেখ করা হয় নি, সে কারণে বহু মানুষকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে আমি নিজে দেখেছি। অথচ প্রশ্নকারীরা ভুলে গিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনাকে লেখা চিঠির খামে প্রাপকের স্থানে লিখে দেয়া যেতো ‘শেখ মুজিব ভাই’, নিঃসঙ্কোচে।
১৯৭৩ সালে নীলফামারিতে দেয়া এক ভাষণে আপনি বলেছিলেন, “মানুষ চায় কী জীবনে? কেউ চায় অর্থ, কেউ চায় শক্তি, কেউ চায় সম্পদ, কেউ চায় মানুষের ভালোবাসা। আমি চাই মানুষের ভালোবাসা।” বাংলার আপামর মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আপনি অধিকার করে নিয়েছিলেন তাদের নেতা, তাদের ভাই হিসেবে। অথচ আপনার দলটি আপনাকে উপলব্ধি করার চেষ্টাটুকু করলো কিনা সন্দেহ। আপনার লেখনিতে আপনি বারংবার কারাগারের সলিটারি কনফাইনমেন্টে একাকী থাকার কষ্টের কথা বলেছেন, এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি আয়নাঘরে কীভাবে বছরের পর বছর মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল।
০৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আমার এক বন্ধু লিখেছিলেন, “কৈশোরে যার জন্য গলা ফাটিয়েছি, তারুণ্যে তিনি করেছেন বিব্রত আর যৌবনে করেছেন আশাহত, বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ।” এর পেছনেও কারণ হিসেবে আপনাকে উপলব্ধি করতে না পারার বিষয়টিই সামনে চলে আসে। ১৯৭২ সালে ঢাকায় এক ভাষণে আপনি বলেছিলেন, “আমি কোনো দিন বিশ্বাস করি না, আমার বাংলাদেশের মানুষও বিশ্বাস করে না যে বন্দুকের নলই শক্তির উৎস। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই শক্তির উৎস।” আফসোস এই যে, ২০২৪ সালের আন্দোলনে দেশের আপামর জনগণের উপর নয়, বন্দুকের নলেই ভরসা রেখেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
সরকার পতনের দিন আরো বহু স্থাপনার সাথে সাথে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আপনার স্মৃতিবিজড়িত বাসস্থানটিতেও আগুন দেয়া হয়েছে, চলেছে ভাঙচুর। আপনার এই বাসায় আমি বহুবার গিয়েছি, বারবার গিয়েছি। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার যে যৎসামান্য পড়াশোনা, প্রতিবার এই বাড়িতে ঢুকে আমি সেগুলো ঝালিয়ে নিতাম, মিলিয়ে নিতাম। এই বাড়ি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অসামান্য উপাদান, বাংলাদেশের মানুষের নানামুখী আবেগ যেখানে মিলেমিশে এক হতো। এই বাড়ি আমাকে শিহড়িত করতো। অথচ আপনার দল ও দলের সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা এতটাই বেড়েছিল যে, সেই অনাস্থার বাইরে আপনিও থাকতে পারেন নি, অথবা আপনাকে এর বাইরে থাকতে দেয়ার চেষ্টাই করা হয় নি। রাষ্ট্রের নেতাকে দলের একক অধিকারে, একক কর্তৃত্বে নিয়ে আসলে জনগণের মুজিব ভাই কীভাবে মুজিব ভাই থাকে?
কিন্তু যে কথাটি কয়েক বছর ধরে আমি বেশ কয়েকবার বলে এসেছি, সেটি পুনর্ব্যক্ত করেই আমি এই চিঠি শেষ করতে চাই। ২০২৪ সালের আন্দোলনেও বারবার আপনার বিভিন্ন উক্তি, ভাষণের অংশকে প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে আসতে দেখেছি আমরা। আন্দোলনকারী জনতা সেগুলো বের করে এনেছেন মহাফেজখানা থেকে, ছড়িয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতার কেন্দ্র শেখ মুজিবকে কুক্ষিগত করার বহু চেষ্টার পরও, মুজিবের যে অংশ জনতার কথা বলেছে, এই আন্দোলনে সেই অংশকে জনতা দখলমুক্তও করেছে। তাই এতকিছুর পরও বলতে হয়, বলে যেতে হয়,
যেই মুজিব জনতার, সেই মুজিব মরে নাই।
যেই মুজিব জনতার, সেই মুজিব মরে না।
ইতি,
সংগ্রামী মুজিব ভাইয়ের অন্ধ ভক্ত নয়, এমন এক সাধারণ মানুষ