শিবলী নোমান
চাকরিসূত্রে জাহাঙ্গীরনগর এসে আমি প্রথম যে বাসায় উঠেছিলাম তা ছিল ডি-৪৭। আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষক হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিত্যাক্ত একটি চার তলা ভবনের চতুর্থ তলার সেই বাসাটি আমি বরাদ্দ পেয়েছিলাম। ভবনটির এক পাশের ভিত্তি কলাম ইঞ্চি ছয়েক সরে যাওয়ার কারণে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও তার ফলে পরিত্যাক্ত ভবনের ঐ বাসাটিতে আমি দারুণ দুইটি বছর কাটিয়েছিলাম। ছাদের কিছু অংশ ভেঙে ডাইনিং টেবিলের উপর না পড়লে ঐ বাসাটি আমি আদৌ ছাড়তাম বলে মনে হয় না।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাসা ছেড়ে আসার কালে প্রতিবারই আমি নতুন করে টের পেতাম যে গাছের মতো মানুষেরও শেকড় থাকে, সময়ের সাথে সাথে মানুষের শেকড় গজায়। সেই শেকড় একবার উপড়ে ফেললে তা যেমন বেশ স্থায়ী হয়, তেমনি পুরোপুরি উপড়ে ফেলতে না পারলে শেকড়ের টান আমাদের মনকে বারবার টেনে নিয়ে যায় সেখানেই।
তো, ডি-৪৭ ছেড়ে আমি আস্তানা গেড়েছিলাম ডি-৭৩ নম্বর বাসায়। চার তলা ভবনের নিচ তলার এই বাসায় আমার শেকড় গজায় নি, দুই বছরের বেশি সময় থাকার পরও না। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ঘরগিন্নি সাপের আগমণ থেকে শুরু করে বারান্দার জাল কেটে বারংবার কাপড় চুরির ঘটনা হয়ে আরো নানা ধরনের বিড়ম্বনা ছিল বলেই হয়তো এই বাসাটিকে কোনভাবেই আমার মনে ধরে নি। এমনকি গত দুয়েকদিন খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করেও বাসাটি ছেড়ে যাবো বলে মনের গহীনে কোন কষ্টের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারি নি।
তবে, ডি-৭৩ বাসাটি আমার মনে ধরুক বা না ধরুক, এই বাসাটি পরিবর্তন করা আমার জন্য খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল একেবারে ভিন্ন ও অপার্থিব কিছু কারণে। এই ডি-৭৩ বাসাতেই এক রাতে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ার পর আমার ফোনে ঠিক তেমনই একটি কল আসে, যে ধরনের কলগুলোর জন্য আমি নিজেকে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রস্তুত করার চেষ্টা বা বৃথা চেষ্টা করেছিলাম। সেই রাতে মিনিট দশেকের ভেতর কেশ কিছু ফোন কল আমাকে আমার মায়ের মৃত্যুর তথ্যটি নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
তো, মাকে শেষ দেখা দেখে আবারও ডি-৭৩ নম্বর বাসায় ফিরে আসার পর গত সাড়ে ৯ মাসে আমাকে দুইটি বিষয় প্রচণ্ড রকম তাড়া করে ফিরেছে। যেহেতু আমি ঠিক সেই অবস্থানেই রাতে ঘুমিয়েছি, যেখানে সেই রাতটিতে শুয়েছিলাম, তাই কোন কারণে যদি রাতে ঘুম ভেঙে যেত, কিংবা ঘুম আসতে দেরি হতো, আর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে যদি আমি আবিষ্কার করতে পারতাম যে ঘড়ির কাঁটাগুলো আমার মায়ের মৃত্যুর সময়ের কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছে, আমি তখন অবচেতনভাবেই মাথার ভেতর সাজাতে থাকতাম সেই রাতের ঘটনাগুলো; কোন্ ফোনের পর কোন্ ফোন আসবে, তৈরি করতাম সেই তালিকা; বুঝতে চেষ্টা করতাম আমার মা কি এখনো বেঁচে আছে, আর কতক্ষণ সময় আছে তাঁর কাছে? আর এভাবেই শোবার ঘরের জানালার পর্দার বাইরে থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের দুর্বল এনার্জি বাতির আলো আমাকে মাসের পর মাস তাড়া করে ফিরেছে; যেই আলোর দিকে আমি তাকিয়ে কাটিয়েছিলাম সেই সময়টুকু।
এমনকি রাতে ঘুমানোর জন্য অন্যান্য ঘরের সব বাতি নিভিয়ে আসার সময়ও আমি চোখ প্রায় বন্ধ রাখতাম। প্রাণপণ চেষ্টা করতাম, আর যাই হোক, কোনভাবে যেন বাসার সদর দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে বাইরে থেকে আসা এক চিলতে আলোক বিন্দুতে আমার চোখ না পড়ে। সেই এক চিলতে আলোক বিন্দু যে কতটা তীক্ষ্ণ আর বিধ্বংসী হতে পারে, তা বুঝতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র মায়ের মৃত্যুর রাতেই। সেই রাতে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে অন্যান্য ঘরের আলো জ্বালানোর ঠিক আগে আমার চোখ পড়েছিল সেই তীক্ষ্ণ আলোক বিন্দুটিতেই, যা বিদ্ধ করেছিল আমার অস্তিত্বের প্রতিটি অংশকে।
এই ঘটনাগুলো আমাকে আমার মায়ের শেষ সময়ের কথা মনে করিয়ে দিতো, আমাকে তাড়িয়ে ফিরতো, আমার বুকের ভেতর এক তীব্র জ্বালা আর ব্যথার সৃষ্টি করতো। ডি-৭৩ থেকে সরে যাওয়া আমার জন্য তাই জরুরি ছিল, খুব জরুরি।
এছাড়া, বহুদিন ধরে আরেকটি বিষয় আমি খুব সচেতনভাবে মনে করার চেষ্টা করেছি। আর তা হলো, আমার মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা হওয়ার ঘটনা। স্মৃতি হাতড়ে আমি কিছুই ঠাওর করতে পারি নি আজও, যেন এক লহমায় কোন এক প্রোগ্রামার শিফট ডিলিট চেপে মুছে দিয়েছেন ঐ অংশটুকুই। এ বড় নির্মম পরিহাস যে, একটা মানুষের সাথে শেষ দেখা হওয়ার স্মৃতি আমি হাতড়ে ফিরছি দিনের পর দিন, পাচ্ছি না; কিন্তু ঠিক সেই একই মানুষের যে স্মৃতি থেকে আমি দূরে সরে যেতে চাচ্ছি, তা আমাকে তাড়িয়ে ফিরছিল রোজ।
আপাত দৃষ্টিতে আমার মনে হয়েছিল, ডি-৭৩ ছেড়ে যেতে পারলে এই তাড়িয়ে ফেরার অবসান ঘটবে। অথচ কাল ডি-৮০ নম্বর বাসায় ওঠার পরই প্রথম মনে পড়লো, ২০১৯ সালের ১২ই অক্টোবর বাদ আছর ডি-৪৭ এর পশ্চিমমুখী জানালায় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ডি-৮০ নম্বর বাসাটি দেখিয়ে তাঁকে বলেছিলাম, “ঐ বাসাটা খালি হবে, উঠতে পারলে ভালো হয়।” সেই কথা হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর আমি বাসাটিতে উঠতে পারলাম। আর এখন নিজের বাসা থেকে ডি-৪৭ এর দিকে তাকালে আমি আমার মাকে দেখতে পাই, যিনি তাকিয়ে আছেন ডি-৮০ নম্বর বাসার দিকে, যেখানে তাঁর ছেলে উঠতে চায়।
মা তাকিয়ে আছেন ডি-৮০ নম্বর বাসার দিকে, যেখানে তাঁর ছেলে উঠতে চায়। 🙁
সময়, মা, হঠাৎ নাই হয়ে যাওয়া, পলেস্তরা খসা ডি-৪৭ সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়। আমার মনে হইতে থাকে, এমন কোন আইডেন্টিকাল টাইমের ফ্রাকশানে আমিও ছিলাম। কে জানে, হয়তো নির্ঘুম ঘড়ির কাটায় চলতে থাকা অস্থিরতাটুকু আমার কাছেও আসে।
তাহলে বলতেই হয়, আমরা কমরেড, অভিবাদন!