শিবলী নোমান
যাপিত জীবনের নানান পর্যায়ে প্রায়ই এমন কিছু মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় বা যোগাযোগ ঘটে, যাদের সাহচর্য কেন আমাদের এতটা আনন্দ দেয়, বা তাদের উপস্থিতিতে কেন আমরা এতটা উৎফুল্ল হয়ে উঠি, তার কোন ব্যাখ্যা আমরা তৈরি করতে পারি না। কিন্তু জুনিয়র বা শিক্ষার্থীদের প্রায় পুরো একটি ব্যাচকে নিয়ে যদি এমনই মনোভাব তৈরি হয়, তাহলে তার পেছনের কারণ বের করা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের ৪৫তম আবর্তন আমার কাছে অনেকটা সেইরকম মানুষদের একটি দল, যাদের সামষ্টিক বা একক, যে কোন ধরনের সাহচর্য আমাকে দারুণ সুন্দর কিছু সময় উপহার দেয়; এবং এই আবর্তনের শিক্ষার্থীদের সাথেই আবার আমার যে পরিমাণ বিব্রতকর ও বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, সেগুলো মাথায় রাখলে এই ভালো লাগার কারণ স্বয়ং ঈশ্বরের খেয়াল ছাড়া অন্য কিছু ধরে নেয়ার উপায় থাকে না।
৪৫তম আবর্তন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, তখন আমাদের স্নাতক পর্যায়ের পড়ালেখা একেবারে শেষের দিকে। সেই সময়টা আমাদের জন্য রঙিন দুনিয়ার সাদাকালো হওয়ার শুরু, তাই ঐ রঙিন দুনিয়ার রঙিনতম পর্যায়ে প্রবেশ করা ৪৫তম আবর্তনের দিকে তাকিয়ে নিজেদের চোখ ঝলসানোর মতো সময় কিংবা ইচ্ছা, কোনটা আমাদের খুব বেশি ছিল না।
৪৫তম আবর্তনকে আমি প্রথম খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলাম খেলার মাঠে, বিভাগের আন্তঃব্যাচ ফুটবল টুর্নামেন্ট চলাকালে। এরপর রিডার্স’ ফোরামের কাজ করতে গিয়ে এই আবর্তনের আরো কিছু দারুণ মানুষের সাথে পরিচয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ করা পর্যন্ত এসব মোলাকাত ব্যতিরেকে আন্তঃবিভাগ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিভাগের একটি ম্যাচে এই আবর্তনের একজনের সাথে হালকা বাক-বিতণ্ডার অধিক উল্লেখযোগ্য কিছু মনে পড়ে না আমার। তবে এই আবর্তনটিকে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে খুবই বৈচিত্র্যময় ও বহুমুখী এক ঝাঁক ছেলে-মেয়ের সমষ্টি। আমাদের ৪১তম আবর্তন অনেকটা এরকম ছিল বলেই অবচেতন মনে ৪৫ এর জন্য এই আলাদা আবেগ কাজ করে কিনা, তা নিয়ে ফ্রয়েডবাদীরা ভালো বলতে পারবেন।
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে শিক্ষকতা করতে এসে প্রথম ক্লাসটি নিয়েছিলাম এই ৪৫তম আবর্তনের, ১৫ নভেম্বর। এরপর টানা তিন বছর তাদের সাথে ক্লাসে দেখা হয়েছে, ক্লাসের বাইরে দেখা হয়েছে আরো বেশি। ক্লাসের ভেতর আমাদের যত সঙ্কট-সমস্যা-বিড়ম্বনা, সবকিছুর সমাধানই হয়েছে ক্লাসের বাইরে। আমি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করতাম, আজকেই এই আবর্তনের কোন একজন বা কতিপয়ের কোন আচরণ বা কথায় যখন ভাবতাম ৪৫ এর সাথে এই শেষ, ঠিক তার দুইদিনের মাথায় আমি এই আবর্তনেরই একদল ছেলে-মেয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছি মুরাদ চত্বর-ক্যাফটারিয়া-মহুয়া বা অন্য কোথাও।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই আবর্তনে আমি এমন কিছু মানুষের সাথে মিশতে পেরেছি, যারা দিনশেষে নিখাদ ভালো মানুষ, সাথে প্রচণ্ড আবেগী। ওদের সাথে নিজের পাওয়া-না পাওয়ার কথা ভাগ করে নেয়া যায়, ওদের সাথে ঝগড়া করে কালই একসাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক জীবনে এই আবর্তনের শেষ দিনটিতে আমি লিখেছিলাম, ৪৫তম আবর্তনকে আমি লবণের মতো ভালোবাসি। দূরে থাকতে চাই, কিন্তু কী এক অদ্ভুত আকর্ষণে বারবার কাছে চলে যাই।
প্রথম ক্লাস নিতে গিয়ে যখন ভাবতাম ৪৫ এর বাচ্চাগুলাও থার্ড ইয়ারে উঠে গেছে, অবাক হতাম। আর আগামীকাল বিভাগের পক্ষ থেকে ৪৫তম আবর্তনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানোর আয়োজন, সব কিছু ভেঙে পড়ার মতোন।
এই উপলক্ষ্যে এই মানসিকভাবে গরিব ও অধমের পক্ষ থেকে ভালোবাসা জানানো ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে!