শিবলী নোমান

কাশ্মীর: ভারত যেখানে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হয়ে যায়

শিবলী নোমান

২০১৯ সালের এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দলীয় ইশতেহারেই ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি নির্বাচনে জয়লাভ করলে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা রদ করার পরিকল্পনা জানিয়েছিল। নির্বাচনে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং নিজেদের রাজনৈতিক জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স তথা এনডিএভুক্ত অন্যান্য দলের কোন ধরনের সহায়তা ছাড়াই কেন্দ্রে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে যায়। গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলতে হলে এটুকু বলেই নিতে হবে যে, নির্বাচনের ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করার ম্যান্ডেট ভারতের জনগণ বিজেপিকে দিয়েছে নির্বাচনে তাদেরকে নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে।

তবে ভাবনার বিষয় হলো আদর্শিক কথা দিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি চলে না, কখনো চলেও নি। তাছাড়া গত ৭২ বছর ধরে কাশ্মীরে যা হচ্ছে সেটিও কোন আদর্শিক অবস্থা নয় বরং দমনপীড়নের এক নির্মম ইতিহাস। অন্যদিকে, ভারতের সংবিধানের ৩৫(এ) ও ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ রাজ্য হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল এবং নিশ্চিত করেছিল কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্যতা, সেই অনুচ্ছেদে প্রাপ্ত বিশেষ অধিকারের জোরেই কাশ্মীরকে সবকিছুর পরও ভারতের সাথে যুক্ত থাকার তথা ভারতের রাজ্য হিসেবে গণ্য করার পক্ষে কথা বলা যেত। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৪৮ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান প্রথম যুদ্ধের পর যখন জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়, তখন বলা হয়েছিল কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে কাশ্মীরি জনগণ ও তা হবে একটি গণভোটের মাধ্যমে। কিন্তু গত ৭১ বছরে সেই গণভোটটি আর হয়নি, উল্টো কাশ্মীর ইস্যুতে অন্তত দুইবার সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান।  মূলত কাশ্মীরি জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাশ্মীরের ভূমির জবরদখল বা দখল ধরে রাখাই ভারত-পাকিস্তান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে চীনের উদ্দেশ্য হিসেবে সামনে এসেছে।

অন্যদিকে, যে পদ্ধতিতে ও দ্রুততার সাথে ভারতের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংবিধানে প্রদত্ত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেছে, তা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নতুন অধ্যায়ের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পদক্ষেপের পর কাশ্মীর ছাড়াও ভারতের আরও কিছু রাজ্য, বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য (‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত) নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। বিজেপি সরকারের উগ্র হিন্দুত্ববাদের আস্ফালনের সাথে সাথে এই কর্তৃত্ববাদী, সম্প্রসারণবাদী ও জবাবদিহিতাহীন আচরণ সার্বিকভাবে ভারতের জাতীয় ঐক্যকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, সেটি সামনের দিনগুলোতে একটি কৌতুহলোদ্দীপক ডিসকোর্সে পরিণত হতে পারে।

তবে, কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ইস্যুতে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা জরুরি। নোম চমস্কি তাঁর ‘ফেইল্ড স্টেটস’ গ্রন্থে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে নতুনভাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন পশ্চিমাদের আরোপিত ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’-র তকমা অনেকটাই অমূলক এবং চমস্কি প্রদত্ত ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’-র তালিকায় পশ্চিমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রথম দিকে। এক্ষেত্রে চমস্কি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দুইটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, এসব রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মান্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না তথা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে। দ্বিতীয়ত, এসব রাষ্ট্র সহিংসতার হাত থেকে নিজের দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না।

প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন অন্যান্য দেশের সাধারণ আইনের মতো অবশ্য অনুসরণীয় না হলেও সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন, জেনেভা কনভেনশনসমূহ, হেগ কনভেনশনের মতো বিষয়গুলো মান্য করার প্রশ্নটি অনেক আন্তর্জাতিক ঘটনার ক্ষেত্রেই মূখ্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও জেনেভা কনভেনসমূহ মানা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন বিভিন্ন সময় উত্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে, কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কথা বলে যেভাবে দিনের পর দিন সেখানে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সম্প্রতি কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার রদের পর যেভাবে একে পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে কিংবা স্থানীয় রাজনীতিবিদসহ বিশিষ্ট নাগরিকিদের গৃহবন্দী (সরকারি ভাষ্যে নিরাপত্তার নামে) করা হয়েছে, তা থেকে কাশ্মীরি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে এসেই যায়। উপরন্তু গত তিন দশকে ৯৫ হাজার কাশ্মীরি হত্যার একটি সংবাদ এখন গণমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ, ভারতের হাত ধরে কাশ্মীরে যদি কোন ধরনের গণহত্যা (জেনোসাইড, পলিটিসাইড, ম্যাস কিলিং কিংবা ডেমোসাইড) সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে কিন্তু ভারত নিজের নাগরিকদের সহিংসতা থেকে নিরাপদ রাখতে স্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হচ্ছে। অর্থাৎ চমস্কি প্রদত্ত ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতে বর্তমান।

কাশ্মীর এমন এক ইস্যু যা মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন সংকটের মতো মানবসৃষ্ট এবং ইচ্ছাকৃতভাবে একে দীর্ঘসূত্রী করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান-চীন এক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্যবাদী আচরণ বজায় রেখে কাশ্মীরি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চাপা দিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলের মানুষেরই সবচেয়ে বেশি অধিকার রয়েছে তাদের নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার। ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মীর (ভারত বা পাকিস্তান বা চীন নিয়ন্ত্রিত, নির্বিশেষে কাশ্মীর) অঞ্চলের সাধারণ নাগরিকদেরকেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার দিতে হবে তারা কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে নির্ধারণ করবে। এছাড়া আর সবকিছুই হবে চাপিয়ে দেয়া, সাময়িক সমাধান, যা সমস্যাকে শুধুই বাড়িয়ে তুলবে, হয়ত ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় যুক্ত করবে নতুন নতুন নাম।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।