শিবলী নোমান
বাংলাদেশের গণমাধ্যমসমূহ আপামর জনসাধারণের আস্থা বেশ আগেই হারিয়েছে, এই কথা বলা মোটাদাগে বাস্তবতার অত্যুক্তি হবে না। অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের মালিকসমূহের ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষার পায়তারাকে এর একমাত্র কারণ বলা যাবে না। বরং পুরনো কাসুন্দির সাথে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের স্বীয় স্বার্থান্বেষণ ও অন্ধ দলানুগত্য মূলত সাংবাদিকতাকেই এই পেশাগত ক্ষেত্র থেকে এক প্রকার বাজেয়াপ্ত করে ফেলেছে।
এক্ষেত্রে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ভোটপ্রদান বিষয়ক সংবাদ প্রকাশ করে আলোচনায় উঠে আসে বেসরকারি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টেলিভিশন। দিনব্যাপী ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম-অভিযোগ দর্শকের সামনে তুলে ধরে অন্তত সামাজিক মাধ্যমে নিজেদেরকে আলোচনার বিষয়ে পরিণত করতে সফল হয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলটি। নির্বাচনের দিন বিকাল থেকে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট ও মিম দেখে খালি চোখে সেটিই মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের অন্য সকল টেলিভশন চ্যানেলের প্রচারিত আধেয়র চেয়ে যমুনা টেলিভিশনের আধেয়কে ‘গ্রেটার দেন’ চিহ্ন দ্বারা প্রকাশের বিষয়টি বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে এই কারণে যে, এই একটি মিম থেকে আসলে একদিকে দেশের গণমাধ্যমগুলোর উপর দর্শকের অনাস্থা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয় দুইটি একসাথে ফুটে ওঠে।
বিভিন্ন আসনে ভোটগ্রহণকালীন নানা অনিয়মের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে যমুনা টেলিভিশনকে আলোচনায় আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম বড় ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে, সংবাদ হিসেবে চাঞ্চল্য যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন দর্শকদের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে অবস্থান করে, তাই গণমাধ্যম ক্ষেত্রে চলমান ফাঁকা স্থানটি দখল করে নির্বাচনকালীন অনিয়ম-অভিযোগ প্রকাশ করে সেই ফাঁকা স্থান পূরণের মাধ্যমে দর্শকের মন, মগজ ও আলোচনায় উঠে আসার সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য যমুনা টেলিভিশনের একটুখানি সাহসমিশ্রিত ইচ্ছা ব্যতীত খুব বেশি কিছু প্রয়োজন ছিল না, মানে সেটুকুই, যেটুকু প্রয়োজন অন্যান্য সকল গণমাধ্যমের বেলাতেও।
কিন্তু বহুকাল আগেই যেখানে বাংলাদেশের বেসরকারি গণমাধ্যম খাত মূলত কর্পোরেট মুনাফামুখী মালিক শ্রেণির হস্তগত হয়েছে – যার ব্যবসায়িক ও মুনাফামুখিনতার একখানা দৃষ্টান্ত নির্বাচনের দিন পত্রিকাগুলোতে পৃষ্ঠাব্যাপী প্রকাশিত দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন এবং প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারেও তা প্রকাশের ভেতর থেকে ইচ্ছা থাকলে বুঝে নেয়া যেতে পারে – সেখানে দেশের এ ধরনের কোন গণমাধ্যমকেই আসলে শুধুমাত্র প্রশংসাসমেত পাশমার্ক দেয়া বোকামি হতে পারে, তবে এই চালাকিতে যমুনা টেলিভিশন ইতোমধ্যেই বেশ সফল হয়েছে বলেই ধরে নিতে হয়। এক্ষেত্রে মূল প্রস্তাবনা হলো, যমুনা টেলিভিশন কর্তৃক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনকালীন অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক গণমাধ্যম যুদ্ধের অংশ, যা আদতে যমুনা টেলিভিশনকে লাভবান করার মাধ্যমে তার মালিকগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক মুনাফা তৈরির মাধ্যম হওয়ার সম্ভাবনায় পূর্ণ।
আমাদের স্মৃতিশক্তি যদি খুব দুর্বল না হয় অথবা আমাদের সাথে প্রতারণা না করে, তাহলে মনে থাকার কথা যে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন গভীর রাত অথবা নির্বাচনের দিন ভোরবেলা থেকে যমুনা টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ ছিল, সেই নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচার চলাকালে ঢাকা-১ আসনে যমুনা টেলিভিশন ও একই মালিকানায় থাকা জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধিদের প্রতিপক্ষ কর্তৃক মারধরের সংবাদ প্রকাশের বিষয়টিও আমাদের মনে থাকার কথা। কিন্তু মজার বিষয় হলো ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই আসন থেকে যমুনা গ্রুপের সেই সময়ের চেয়ারম্যানের স্ত্রী সালমা ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান, তবে সেই সময় যমুনা টেলিভিশন বা যুগান্তরের উপর এ ধরনের হামলার তথ্য খুব একটা নেই।
এই না থাকার কারণ ২০১৪ সালে নয়, খুঁজতে হবে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে। এই দুই নির্বাচনেই জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করা সালমা ইসলামের বিপক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করেছেন সালমান এফ রহমান। এক্ষেত্রে উনার যে পরিচয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, তিনি নিজেও আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশন তথা ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও বন্ধ হয়ে যাওয়া ইংরেজি দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মালিক। ঠিক এই কারণেই যমুনা টেলিভিশনের নির্বাচনকালীন তাৎপর্যকে শুধুমাত্র সত্য প্রকাশের সাহস বলা বোকামিপূর্ণ মনে হয়। ২০১৮ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বোধ করি এবার যমুনা টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের চেয়ে এক ধরনের বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে।
তবে, যে কারণে মালিকানার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা হলো, ২৯৯ আসনে ভোট গ্রহণ হলেও যমুনা টেলিভিশনের প্রধান মনোযোগ ঘনীভূত হতে দেখা গিয়েছে ঢাকা-১ আসনকে ঘিরে। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত যমুনা টেলিভিশনের ফেইসবুক পেইজে ভোট চলাকালে অনিয়মের সংবাদসমূহের প্রতি দুইটি (বহু ক্ষেত্রে একটি) সংবাদের পর ঢাকা-১ আসনের সংবাদ দেখা যায়, এক্ষেত্রে ঢাকা-১ আসন সংক্রান্ত তথ্যগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পুনরাবৃত্তিও চোখে পড়ার মতোই।
একইভাবে, এই প্রচার বা প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডকে গণমাধ্যম যুদ্ধ বলার আরেকটি কারণ এই যে, শুধুমাত্র ঢাকা-১ আসনেই যমুনা টেলিভিশনের অন্তত তিনজন প্রতিনিধিকে কাজ করতে দেখা গিয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি আসনে একইরকম গুরুত্ব দিতে হলে যমুনা টেলিভশনের ৮৯৭ জন প্রতিনিধির আজ মাঠে থাকার কথা, ক্যামেরাপারসন সমেত সংখ্যটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই অসম্ভব সংখ্যক প্রতিনিধি যমুনা টেলিভিশনের বুম ও ক্যামেরা হাতে আজ মাঠে ছিল, তা বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এই আসনে যমুনা টেলিভিশনের প্রতিনিধিরা ক্ষেত্রবিশেষে যেভাবে নিজেদের শারীরিক শক্তি ও গলার জোর ব্যবহার করেছেন, মালিক পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা না থাকলে সেটিও দেশের গণমাধ্যমের বাস্তবতায় অসম্ভব একটি বিষয়।
তবে এই লেখার উদ্দেশ্য কোনভাবেই যমুনা টেলিভিশনকে খলনায়ক হিসেবে দেখানো নয়। কারণ খোঁজ নিলে দেখা যাবে ঐ একই আসনে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও তার মালিকপক্ষও একইরকম গুরুত্ব দিয়েছে নানা পন্থা ব্যবহার করে, আবার সমকাল ও চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের মনোযোগ খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের মালিকের নির্বাচনী আসনে। তবে নিজেদের সংবাদ আধেয়র মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থার এক ধরনের বিরোধিতা করার মাধ্যমে যমুনা টেলিভিশন সামাজিক মাধ্যমে যে পরিমাণ হিট-কমেন্ট-রিঅ্যাকশন পেয়েছে, সেটিকে শুধুমাত্র মালিকের নির্বাচনী স্বার্থের বাইরে ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে মিলিয়ে দেখারও সুযোগ রয়েছে, যেহেতু আজকের দিনে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত আধেয় থেকে মুনাফা আসছে হরহামেশাই। এখানেও হয়তো নির্বাচনের দিনে এক প্রকার ফাঁকা মাঠই পেয়েছে যমুনা টেলিভিশন, যাকে একদিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় ২০১৮ সালের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উপায় হিসেবে, অন্যদিকে একে ব্যবহার করা যেতে পারে সামনের বেশ কিছুদিনের আরো আরো মুনাফা তৈরির উদ্দেশ্যেও।
শেষ কথা এই যে, নির্বাচনের দিনে দর্শকের চোখে যমুনা টেলিভিশনের নায়ক বনে যাওয়া গণমাধ্যম চিন্তক ও সংবাদকর্মীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হতে পারে, যদি দেখার সদিচ্ছা থাকে। কিন্তু যমুনা টেলিভিশনের এহেন প্রচারকে গণমাধ্যম যুদ্ধ হিসেবে বিচার করলে তার সকল আধেয়ক অন্তত সত্য বলে মেনে নেয়া বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ কে না জানে, যে কোন যুদ্ধের প্রথম বলি তো সত্য নিজেই। তাই আপাতত বলতে হয়, স্নান করতে ভালো লাগলেও এই ‘যমুনার’ জল দেখতে কালো না হলেও স্বচ্ছ নয়।
জল কালো না হলেও স্বচ্ছ নয়, একথা নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু, আমজনতা/আম স্তরের সংবাদকর্মীর জায়গা থেকে একটা বিষয় বলা যায়। মালিকপক্ষ কিংবা মুনাফার ব্যপার থাকলেও কর্মীদের পক্ষে এরকম প্রেসার/চাহিদা পূরণ খুব একটা সহজ না। স্বাধীন গণমাধ্যমের সময়তো আগেই শেষ। এমন পরিস্থিতিতে এমন অবস্থানের জন্য সাহসী গণমাধ্যমের ভূমিকায় নামা যেকোনো মিডিয়ার ফুডচেইনের শেষ স্তরে থাকা কর্মীদের আমি টুপিখোলা সালাম জানাই।
আরেকটা বিষয় মনে হয়, হোক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কিন্তু, কিছু না বলা/চুপ থাকা/মেনে নেয়ার বাইরে অন্তত কিছু শব্দ উঠলো। রাজনীতি/মুনাফার গভীর সূত্র সাধারণ দর্শকের ধর্তব্যের মধ্যে থাকে না। তারা অন্তত জানলো, কিছু শব্দ হচ্ছে। এইটা বেশ।
হ্যা, আপনার শেষ পয়েন্টটা জরুরি, আমি এই ইস্যুতে লিখবো না ভাবার কারণও এটা ছিল। কিন্তু শিক্ষিত লোকজন ভুল বুঝতো দেখেই মূলত লেখা, কারণ শিক্ষিত মানুষের গণমাধ্যম না বোঝাটা সঙ্কটে ভরা।
প্রথম কথার সাথেও দ্বিমত নাই মোটাদাগে।