শিবলী নোমান
রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য নতুন কোন সমস্যা না হলেও গত ২৫ আগস্টের পর থেকে যে হারে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ও এখনো করছে তাকে অভূতপূর্ব বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে যেভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং সর্বোপরি গণহত্যা শুরু হয়েছে তাকে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সংগঠণগুলো ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এখন এই এথনিক ক্লিনজিং স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের সভ্যতার সঙ্গঘাতের উদাহরন হিসেবে পরিগণিত হবে নাকি সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উদাহরন হিসেবে বিবেচ্য হবে সেই বিচার ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা বা বর্তমান পরিস্থিতির উপর আলোকপাতই বেশি জরুরি বলে মনে হয়।
সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মানবিকতার দিকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গত ২৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আদৌ আশ্রয় দিবে কিনা সে বিষয়ে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশের মানুষের ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী হিসেবে কাটানো সময়ের কথা তুলে ধরে তার সাথে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়টিকে সম্পর্কিত করে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পরও আমরা আমদের অতীতকে ভুলে যাই নি এবং কষ্ট হলেও মানবিক আচরণ থেকে নিজেদের গা বাঁচিয়ে রাখি নি।
কিন্তু সবকিছুর পরও যে প্রশ্নটি থেকে যাচ্ছে তা হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আসলে কোথায়। আগেই বলা হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি নতুন নয় বরং প্রকাশ্য অনুপ্রবেশের এই ঘটনা প্রায় চার দশক আগে থেকে শুরু হয়ে। প্রকৃতপক্ষে কবে থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভূখন্ডে চলে আসা শুরু করেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। তবে এটি নিশ্চিত যে বাংলাদেশ এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। এই ইস্যুতে যে কোন সমাধানে আসতে হলে সবার আগে মিয়ানমার সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলো সবার আগের পূর্বশর্ত। কিন্তু এই ইস্যুতে আমরা সবসময় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারকে পেয়েছি প্রতিকূল ও কট্টর অবস্থানে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় কোনভাবেই বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গাদের পুনরায় ফেরত নেয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় নি। ভবিষ্যতে নিবে তারও কোন সঙ্কেত দেখা যাচ্ছে না। উল্টো রোহিঙ্গা জনগোষ্টীর সকল সদস্যকে সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালাচ্ছে দেশটি। মিয়ানমার ও মিয়ানমারের সরকার যতদিন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে বিচার করা বন্ধ না করবে ততদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে অনে হয় না। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্নতা মিয়ানমারের এই অবস্থানের পিছনে পরোক্ষ সমর্থন প্রদান করে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্যদিকে আঞ্চলিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এখনো শক্তিশালী কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। যদিও রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তানসহ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক ক্ষেত্রে শক্তিধর চীন ও ভারতের মিয়ানমার সরকারের সাথে স্বার্থগত সম্পর্ক থাকায় কোনভাবেই তারা মিয়ানমার সরকারের বিরাগভাজন হতে চাচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মিয়ানমারের সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সুসম্পর্কের স্বার্থ জড়িত। অন্যদিকে চীন মিয়ানমারকে ব্যবহার করতে চায় বঙ্গোপসাগরে আসার জন্য চীনের একটি রুট হিসেবে। এসব কারণে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে কিছুটা বন্ধুহীন মনে হলেও ভবিষ্যতই বলে দিবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্র এই ইস্যুতে বাংলাদেশের মতো মানবিক দিক থেকে বিষয়টিকে বিবেচনা করে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করে কিনা।
আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তার মানবিক অবস্থান গ্রহণ করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা সংকট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদের আলোচনায় এই ইস্যুতে বৈশ্বিকভাবে মিইয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করা জরুরি।
তবে দিনশেষে মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই রোহিঙ্গা সংকট ও গণহত্যার বিষয়টির ভবিষ্যত বেশি নির্ভরশীল তা স্বীকার করতেই হবে। বর্তমানে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর সামনে এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। বাংলাদেশ মানবিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই সেই চ্যালেঞ্জ উতরে গিয়েছে তা মানতেই হবে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আপন দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য এবং রোহিঙ্গাদের উপর চলমান গণহত্যা বন্ধে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো কিভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাই এখন দেখার বিষয়।