শিবলী নোমান
সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে অ্যাভেঞ্জার্স সিরিজের সর্বশেষ চলচ্চিত্র অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেইম। সুপার হিউম্যান কিংবা সুপার হিরোকেন্দ্রিক এই হলিউড সিরিজটি সুপার হিরোকেন্দ্রিক একক চলচচ্চিত্রের স্থলে প্রায় সকল সুপার হিরোকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সেই হিসেবে অ্যাভেঞ্জার্স নামে চারটি চলচ্চিত্র থাকলেও আয়রন ম্যান, হাল্ক কিংবা থরের মতো চলচ্চিত্রগুলোকেও এই সিরিজের সাথে একাত্ম করা যায়। আর নিঃসন্দেহেই সুপার হিউম্যান কিংবা সুপার হিরোদের নিয়ে চলচ্চিত্রের জনরাটি বেশ জনপ্রিয় বিশ্বজুড়ে। একইভাবে বাংলাদেশেও এই সিরিজের জনপ্রিয়তা থাকবে তাও অবাক করার মতো কিংবা নতুন কোন তথ্য নয়।
কিন্তু সম্প্রতি অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেইম চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে যে দৃশ্যপট দেখা গেলো তা নিয়ে মস্তিষ্কে বারংবার ভিন্ন ধরনের স্টিমুলি পাওয়াতেই এই লেখা। আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর বরাতে আমরা দেখেছি যে, অ্যাভেঞ্জার্স সিরিজের সর্বশেষ চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য ভোর থেকে মানুষ সিনেমা কমপ্লেক্স তথা সিনেপ্লেক্সগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ে চলচ্চিত্রটির টিকিট বিক্রি শুরু হলে বা টিকিট বিক্রির জন্য সিনেপ্লেক্সে যাওয়ার পথ খুলে দেয়া হলে ঢাকার একটি মেগা শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে যে দৌড়াদৌড়ি ও হুড়োহুড়ির দৃশ্যপট সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, হাস্যকর তো বটেই।
আলোচনার এই পর্যায়ে অ্যাভেঞ্জার্স চলচ্চিত্র বা তার টিকিট পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ির ঘটনাকে মুলতবি রেখে পাঠকদের একটু জার্মানিতে নিয়ে যেতে চাই। হিটলারের উত্থানের আগের জার্মানি, যা ওয়েইমার রিপাবলিক নামে পরিচিত, সেখানে ফ্রাঙ্কফুটের গোয়থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিকরা নতুনভাবে সামাজিক পদ্ধতি ও চর্চাকে ব্যাখ্যা করার যে প্রয়াস পান তা ফ্রাঙ্কফুট স্কুল নামে খ্যাত। ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের তাত্ত্বিকদের অধিকাংশ মতাদর্শের দিক থেকে বামপন্থি হলেও তারা সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি ও তত্ত্বের সাথে নিজেদের চিন্তাজগত ও দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়ে পুঁজিবাদ ও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ উভয়ের সমালোচনা করতেন। ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের তাত্ত্বিকদের ভেতর অনতম ছিলেন হকহেইমার। নিজে বামপন্থি ঘরানার হলেও বিভিন্ন সময় মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের নানা ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী অস্থিতিশীল বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হকহেইমার চারটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন। প্রথমত, বিশ্বব্যাপী উদার পুঁজিবাদের স্থান ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিবাদ। দ্বিতীয়ত, সকল সমাজে শ্রেণি চেতনা ও শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৃতীয়ত, পুঁজিবাদের অধীনে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে। চতুর্থত, সমাজগুলোতে সমাজতন্ত্রের উত্থানের সম্ভাবনা নাকচ করা যায়।
হকহেইমারের চারটি প্রস্তাবনার ভেতর শেষ প্রস্তাবনা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হতে পারে কিন্তু শেষ দুইটি প্রস্তাবনার কোনটিই এই লেখার সাথে সংযুক্ত নয়। তাই শেষ দুইটি প্রস্তাবনাকে পাশে সরিয়ে রাখছি। অন্যদিকে প্রথম প্রস্তাবনা তথা উদার পুঁজিবাদের স্থানে একচেটিয়া পুঁজিবাদের জেঁকে বসাটা যে বাস্তবতা তা আমরা বিশ্বব্যাপী তো বটেই বাংলাদেশেও দেখতে পাই। আমাদের দেশে যে হারে খাওয়ার দোকান বেড়েছে ও বাড়ছে এবং উৎসব থেকে শুরু করে শোকের দিনগুলোতেও সাজগোজ বা পোশাক কেনার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ও দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা থেকে সহজেই বিষয়টি অনুমেয়। আর বিশ্বব্যাপী নব্য-উদারনীতির মাধ্যমে যে একচেটিয়া পুঁজিবাদকে উসকে দেয়া হচ্ছে, তার ঝাপটা তো আমাদের দেশেও পড়ারই কথা। আমার মনে হয় হকহেইমারের দ্বিতীয় প্রস্তাবনাটি প্রথম প্রস্তাবনার সাথেই সংযুক্ত। একচেটিয়া পুঁজিবাদে মানুষকে শ্রেণি চেতনাসম্পন্ন হতেই হবে, ফলে বৃদ্ধি পাবে শ্রেণি বৈষম্যও।
এই শ্রেণি চেতনা বৃদ্ধির একটি জনপ্রিয় প্লাটফর্ম হলো হালের সামাজিক মাধ্যম। সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে যত বেশি প্রদর্শন করা হবে তত বেশি নিজের শ্রেণি অবস্থান সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা সম্ভব হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন সামাজিক মাধ্যম অব্যবহারকারীরা আগেই শ্রেণি অবস্থানে নিচে চলে যায়, তা সে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের আর্থিক সঙ্গতি কিংবা সুযোগ বা দক্ষতা যার অভাবেই হোক না কেন। অন্যদিকে, আমরা যা নই নিজেদের সামাজিক মাধ্যমে সেভাবে উপস্থাপন করে দ্বৈত জীবন যাপনের বিষয়টিতো আছেই, যাকে বলা যেতে পারে সামাজিক মাধ্যমে ‘জেকিল-হাইড প্রবণতা’। আবার একজন মানুষকে বিচার করার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে তার পোস্ট, স্ট্যাটাস ও অন্যান্য কর্মকান্ড।
অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেইম নিয়ে আলোচনা করে ফ্রাঙ্কফুট স্কুল হয়ে সামাজিক মাধ্যম নিয়ে আলোচনা কিন্তু কোনভাবেই বিচ্ছিন নয় বরং এক সূত্রে গাঁথা। কারণ গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশ ব্যবহৃত সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম ছিল অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেইম। আলোচনাটি এমন পর্যায়েই এগিয়েছিল যে চলচ্চিত্রটির একটি টিকিট পাওয়া এবং পেয়ে সামাজিক মাধ্যমের নিজের অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে অন্যদের না দেখালে অনেকের মানসম্মান থাকছে না, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়। আমার ধারণা চলচ্চিত্রটি দেখে সিনেপ্লেক্স থেকে ছবি পোস্ট করা কিংবা চেক-ইন দিয়ে বন্ধুদের জানান দেয়া শুরু হয়ে গিয়েছে কিংবা অচিরেই শুরু হবে।
এখন প্রশ্ন কিংবা ভিন্নমত আসতে পারে এভাবে যে, এর আগে আয়নাবাজি চলচ্চিত্র দেখার জন্যও তো টিকিটের জন্য হাহাকার ছিল কিংবা হলভর্তি দর্শক ছিল, ফেইসবুকে পোস্ট ও চেক ইনও ছিল। সবই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আয়নাবাজি চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমাদের দেশের ভেতর যে পাবলিসিটি বা জনসংযোগ করা হয়েছে তার ছিটেফোঁটাও তো অ্যাভেঞ্জার্সের ক্ষেত্রে হয় নি। মূলত হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের টার্গেট অডিয়েন্স লিস্টে বাংলাদেশের দর্শকরা আছেন কিনা সেটি নিয়েই আলাদা বিতর্ক হতে পারে। তবে আয়নাবাজি ও অ্যাভেঞ্জার্স উভয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি এক ও অবিকল, তা হলো চলচ্চিত্রটির দেখার আগে পরে বা টিকিট পাওয়ার আগে পরে তা সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে অন্যদের জানান দেয়া। যার ফলে অন্তত সামাজিক মাধ্যমে হাই স্ট্যাটাসের সদস্য হওয়া সম্ভব বলে অনেকেই কনে করতে পারেন।
ফ্রাঙ্কফুট স্কুল থেকে হকহেইমার যে প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন, তার অন্তত দুইটি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের উপর প্রযোজ্য বলে দৃশ্যমান হয়। আর এর ফলে বাংলাদেশে একচেটিয়া পুঁজিবাদ জেঁকে বসার পূর্বশর্ত, একটি কনজিউমার বা ভোক্তা সমাজ যে তৈরি হয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য কনজিউমারিজমের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেণি অবস্থান জানান দেয়া, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন এই ধরনের আত্মকেন্দ্রিক শ্রেণি চেতনা সামনের দিনগুলোতে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করে তাই দেখার বিষয় এবং তা দেখতেই আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।