শিবলী নোমান
আজ থেকে শতবছরেরও অধিক সময় আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”। জানি না আগামীদিনে কী ধরণের নগর সভ্যতার কথা কল্পনা করে কবিগুরু এই কবিতা লিখেছিলেন। তবে কবিগুরুর আশঙ্কা যে অবাস্তব নয়, সভ্যতা যে আমাদের সম্পর্কগুলো, আমাদের সাংস্কৃতিক আবহকে পরিবর্তিত করছে প্রতিদিন, তা অসত্য নয়। নগর সভ্যতায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে যে মাধ্যম তা হলো নিউ মিডিয়া বা নয়া মাধ্যম। আর যে কোন পরিবর্তনের প্রাথমিক শিকার হয়ে থাকে আমাদের সমাজের শিশুরা। নিউ মিডিয়া বা নয়া মাধ্যমের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না।
প্রাথমিক আলোচনা থেকে এটি মনে হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে যে পরিবর্তনকে এক্ষেত্রে খারাপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তা মোটেই নয়। পরিবর্তনেরও আর সবকিছুর মতো ভালো-মন্দ উভয় দিক আছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয় হলো কোন ধরণের পরিবর্তন আমাদেরকে কিভাবে পরিবর্তিত করছে এবং দিনশেষে এর ফলাফল কী।
যে কোন পরিবর্তন বা পরিবর্তনের ফলাফল নিয়ে আলোচনার আগে গণমাধ্যম এবং নয়া মাধ্যম নিয়ে আলোচনা জরুরি। গণমাধ্যম হলো সেই মাধ্যম যা ব্যবহার করে কোন বার্তা বা আধেয় বিপুল সংখ্যক পাঠক-শ্রোতা-দর্শক তথা অডিয়েন্সের কাছে একই সময়ে ছড়িয়ে দেয়া যায়। একটা সময় ছিল যখন শুধুমাত্র সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনকেই আমরা গণমাধ্যম হিসেবে ধরে নিতাম। বলা যেতে পারে মোটামুটি ২০০০ সাল পর্যন্ত আমরা এই তিনটি মাধ্যমকেই গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছি। ২০০০ সালে গণমাধ্যম অধ্যয়নে ‘সেভেন মাস মিডিয়া’-র ধারণা চলে আসে। এসময় প্রচলিত তিনটি গণমাধ্যমের সাথে আরও চারটি মাধ্যমকে গণমাধ্যম হিসেবে পরিগণিত করা হয়। গণমাধ্যম হিসেবে যুক্ত হয় যে কোন রেকর্ডিং, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট এবং মোবাইল। বলা যেতে পারে যে, ইন্টারনেট এবং মোবাইলের মাধ্যমে গণমাধ্যমগুলোর ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, হঠাৎ করেই একজন মানুষ একটি গণমাধ্যমের মালিক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর সাথে যখন একবিংশ শতাব্দীর শূন্য দশকে নিউ মিডিয়া বা নয়া মাধ্যম যুক্ত হয়, তখন তা এক অস্বাভাবিক এবং অত্যাধিক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়। ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনকে গণমাধ্যম হিসেবে পাওয়ার পর, শুধুমাত্র নয়া মাধ্যমের আবির্ভাবের কারণে এই দু’টি গণমাধ্যমের সফল ব্যবহার শুরু হয়। কারণ ইন্টারনেট ছাড়া নয়া মাধ্যম চলতে পারে না, এটিই নয়া মাধ্যমের প্রাথমিক শর্ত। অর্থাৎ ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতা এবং নয়া মাধ্যম তথা সামাজিক মাধ্যোমে বিচরণ মিলেমিশে একাকার হয়ে এক শক্তিশালী মাধ্যমকে সামনে নিয়ে আসে। একই সাথে বর্তমান সময়ে ট্যাবের মতো স্মার্ট ফোনের নানা আপডেটেড ভার্সনও একই অবস্থাকে বজায় রাখছে।
এখন যদি গণমাধ্যম ও নয়া মাধ্যমের আলোচনা থেকে আমাদের শিশুদের মনস্তত্ত্বের দিকে চোখ ফেরাই তাহলে দেখবো যে, আমাদের শিশুরা বর্তমান সময়ে স্মার্টফোনের প্রতি ভয়াবহ আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখানে শিশু বলতে এক বছর বয়সী শিশুকেও বোঝানো হচ্ছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে অবুঝ শিশুদের ভেতরই নয়া মাধ্যমের প্রতি আসক্তি বেশি। একটি শিশুকে খাওয়ানোর জন্য, ঘুমা পাড়ানোর জন্য মা-বাবা কিংবা অভিভাবক নয়া মাধ্যম ব্যবহার করে গান শোনার ব্যবস্থা করছেন। শিশুদের কাছে মা-বাবার স্মার্ট ফোন বা ট্যাব এখন খেলনা হিসেবে সামনে চলে আসছে। শিশুরা বাইরে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা না করে ঘরে বসে স্মার্ট ফোন বা ট্যাবে বিভিন্ন ইন্টারঅ্যাক্টিভ গেইমে ব্যস্ত থাকছে। অর্থাৎ প্রচলিত সমাজের বাইরে শিশুদের আরেকটি সমাজ তৈরি হচ্ছে। মূলত গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের পর নতুন শতাব্দীর শূন্য দশকে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি খুব ভালো ভাবে সামনে চলে আসছে। আর এখান থেকেই সামষ্টিক সমাজ থেকে ব্যষ্টিক সমাজে পদক্ষেপ বিষয়ক প্রস্তাবনা শুরু হয়।
যোগাযোগ বিদ্যার একটি বড় অংশ হলো আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। এখানে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির যোগাযোগে ব্যক্তিদ্বয় কোন ধরণের সংস্কৃতি থেকে এসেছে তার উপর যোগাযোগের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে বলে বলা হয়। এক্ষেত্রে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক সংস্কৃতির কথা বলা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টেলা টিং টুমি তাঁর ১৯৮৫ সালের ‘ফেইস নেগোসিয়েশন’ তত্ত্বে আন্তঃব্যক্তিক সংঘাতের ক্ষেত্রে এই দুই ধরণের সংস্কৃতির উল্লেখ করেন। সামষ্টিক সংস্কৃতির সদস্যরা সবক্ষেত্রে তার পুরো সমাজ ও সমাজের সকল সদস্যের কথা চিন্তা করে যে কোন কাজ করে। আর ব্যষ্টিক সমাজের সদস্যরা শুধুমাত্র নিজের কথা ভেবে যে কোন কাজ করে বা সিদ্ধান্ত নেয়। যোগাযোগবিদ হ্যারি ট্রায়ানডিস এক্ষেত্রে তিনটি মাত্রার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত সত্ত্বা, উদ্দেশ্য ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক সংস্কৃতির সদস্যদের ভূমিকা ভিন্ন হয়। স্টেলা টিং টুমির তত্ত্বে বেশির ভাগ এশিয়ান দেশগুলোকে সামষ্টিক সংস্কৃতির দেশ এবং পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যষ্টিক সংস্কৃতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দেখা যায়, আন্তঃব্যক্তিক সংঘাত বা দ্বন্দ্ব দূরীকরণে সামষ্টিক সংস্কৃতির সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ ছাড় দেয় ও আলোচনা করে কিন্তু ব্যষ্টিক সংস্কৃতির সদস্যরা নিজের স্বার্থ ছাড় দেয় না এবং এক ধরণের একগুয়েমি দেখায় বা কোন আলোচনায় যায় না।
এখন আলোচনার বিষয় হলো, নয়া মাধ্যমগুলো যেহেতু পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত, তাই এসবের বৈশিষ্ট্যই হলো এগুলো ব্যষ্টিক সংস্কৃতির মানুষের ব্যবহারের উপযোগী। বাস্তব জীবনে নিঃসঙ্গ মানুষকে সঙ্গ দেয়ার জন্য, সময় কাটানোর উপায় হিসেবে এসব নয়া মাধ্যমের উত্থান। অথবা যত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এসব নয়া মাধ্যমের উত্থান হোক না কেন, দিনশেষে এগুলো নিঃসঙ্গ মানুষকে ভার্চুয়ালি আলাদা একটি জগত তৈরিতে সহায়তা করে, যে জগত ঠিক ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুযায়ী তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি হলো, এই শতাব্দীর শূন্য দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত এবং ভবিষ্যতে যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করবে, তারা যেভাবে স্মার্ট ফোন ও ট্যাব তথা নয়া মাধ্যম ব্যবহার করছে, এর ফলে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত একটি জগত তৈরি হচ্ছে। শুধুমাত্র গেইম খেলে বা পুতুলের সাজ-সজ্জা দেখে আমাদের শিশুরা শুধুমাত্র সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তাই নয়, বরং এমন একটি বাস্তবতা তৈরি করছে যেখানে, সামনের দিনগুলোতে একটি স্বার্থপর এবং ব্যষ্টিক সংস্কৃতির সমাজ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সামষ্টিক সংস্কৃতির যে আবহ বাংলাদেশে ছিল, দেশের শহরগুলো থেকে তা অনেকাংশে লুপ্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। আর শিশু বয়স থেকে নয়া মাধ্যমের এই অধিক ও অপব্যবহারের ফলে ব্যষ্টিক সংস্কৃতির দেশের দিকে পরিবর্তনের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এখন থেকেই ভাবতে হবে, নাহলে হাজার বছরের সামষ্টিক সংস্কৃতির বাংলাদেশকে ব্যষ্টিক সংস্কৃতির দেশে পরিণত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না। একই সাথে অপ্রাপ্তবয়স্করা কিভাবে নয়া মিডিয়া ব্যবহার করবে তার নীতিমালা প্রণয়নও অনেকটাই সময়ের দাবি।