শিবলী নোমান
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ইরাক এনকোয়ারি তথা চিলকট এনকোয়ারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পর প্রকাশিত হল এই রিপোর্ট। স্যার জন চিলকটের নেতৃত্বে বোর্ডের ২৬ লাখ শব্দের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০০৩ সালের ইরাক অভিযান ছিল একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ; বলা হয়েছে সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না, যদিও এই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের হুজুগ তুলেই ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল এবং জনগণের ভিতর যুদ্ধের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়েছিল; আরও বলা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সাদ্দাম হোসেন ও ইরাকের সাথে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ পথগুলো অনুসরণ না করে যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের ১৩ বছর পর চিলকট রিপোর্ট প্রকাশিত হল। এর ফলে টনি ব্লেয়ারসহ যেসব ব্রিটিশ নাগরিক এই অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে মদদ দিয়েছিলেন তাদের বিচারের সম্মুখীন করার সুযোগ তৈরি হল। কিন্তু রিপোর্টে যেসব বিষয় বেরিয়ে এসেছে তা মোটেও নতুন কোন আবিষ্কার নয়। ২০০৩ সালেই নোম চমস্কি বিভিন্ন কলামে উল্লেখ করেছিলেন যে ইরাক যুদ্ধটি ইঙ্গ-মার্কিন জোটের একটি নয়া সাম্রাজ্যবাদী প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষসহ সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষ ইরাক যুদ্ধকে শুধুমাত্র তেলের দখলের জন্যে চাপিয়ে দেয়া একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ আখ্যা দিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিলেন।
এটি ভুলে যাওয়ার নয় যে সাদ্দাম হোসেন ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ছিলেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটনের পর মার্কিন মদদপুষ্ট হয়েই সাদ্দাম হোসেন ইরানের সাথে আট বছর মেয়াদী দীর্ঘ কিন্তু ফলাফলহীন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুয়েত দখল করেই সাদ্দাম হোসেন পরিণত হলেন একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী (!) হিসেবে। এবং বিন লাদেনের মতই, সাদ্দাম হোসেন পরিণত হলেন মার্কিনীদের দ্বারা সৃষ্ট আরেকটি ফ্রাঙ্কেস্টাইনে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। সাদ্দাম হোসেন বন্দী হওয়ার পর এফবিআই এজেন্ট জর্জ পাইরো সাদ্দামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং এ প্রসঙ্গে সাদ্দাম বলেছিলেন, “যদি আমার কাছে সত্যিই এমন অস্ত্র থাকতো, আমি সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করতাম।”
প্রকৃতপক্ষে ইরাক যুদ্ধের চেয়ে এর ফলাফল হয়েছে আরো বেশি ক্ষতিকর। এটি স্পষ্ট ছিল যে এই যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেন ও ইরাকের পতন ঘটবে কারণ সামরিক ক্ষমতার কোন তুলনাতেই ইরাক পশ্চিমা জোটের সমতুল্য ছিল না। সাদ্দামের পতন হল। এখানেই ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তির কথা ছিল। কিন্তু এখান থেকেই শুরু হল বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ডিসকোর্সের, সেটি হল আইএস। অন্যদিকে তথাকথিত আরব বসন্তের অন্যতম ক্ষেত্র সিরিয়া হয়ে উঠলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধের ময়দান। আবার এটি পরিণত হল আইএসের তথাকথিত খিলাফতের ময়দান হিসেবেও। কিন্তু আজকের পৃথিবীর প্রধান আতঙ্ক আইএসের পিছনে কারা রয়েছে? আমরা ইরাকের ক্যাম্প বুকার কথা জানি। এখানে ইরাকের সুন্নি যোদ্ধা তথা বন্দীদের আটক রাখা হত। পরবর্তীতে জানা গিয়েছে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে থাকা এই ক্যাম্পটি বন্দীশালার চেয়ে জঙ্গিদের আদর্শিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হিসেবে বেশি কাজ করেছে। আইএসের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদীও এই ক্যাম্পেই আটক ছিলেন। মার্কিন সৈন্যরা যখন ইরাক ছেড়ে চলে যায় তখন ক্যাম্প বুকায় আটক সকল বন্দীদের ছেড়ে দিয়ে যায়। আর এখন সেই সব বন্দীই ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অংশ দখল করে কথিত খিলাফতের কালো পতাকা বহন করছে। রাশিয়া আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে তার স্বার্থেই, বাশার আল আসাদকে তার প্রয়োজন। বাশার আল আসাদের সিরিয়া রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রের বাজার, একইসাথে রাশিয়া সিরিয়ার টারটুস বন্দর ব্যবহার করতে পারে কোন ধরণের আলাদা খরচ ছাড়াই। ফলে যদি বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটে এবং মার্কিনপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে তা হবে রাশিয়ার জন্যে বিশাল ক্ষতি। অন্যদিকে আরব বসন্তের নামে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতন ঘটানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আইএস হল মার্কিনীদের একই উদ্দেশ্যে আরেকটি নতুন প্রয়াস। তাই সিরিয়া এখন প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্র, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রয়োজন নেই, শহরগুলো রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আছে শুধু সিরিয়ার মাটির অধিকার, তা হবে রাশিয়ার মত অথবা মার্কিনীদের মত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, বিশ্বব্যাপী নিজস্ব প্রভাব বলয় কায়েম করার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল একটি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর। তারা ইসলাম ধর্মকে সেই প্রতিদ্বন্দ্বী করেছে বেশ আগেই। তারা আফগানিস্তানে একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ করেছে; যেখানে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধের সময় তাদের ঘনিষ্ট বন্ধু বিন লাদেনকে মোস্ট ওয়ান্টেড সস্ত্রাসী ঘোষণা দিয়েছে। পরবর্তীতে তারা ইরাক দখল করেছে; আরব বসন্তের ফলাফল গিলে খেয়েছে; আর এখন আইএসকে সামনে এনেছে। কিন্তু এটি অসম্ভব কল্পনা হবে না যে, আইএস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আরেকটি ফ্রাঙ্কেস্টাইনে পরিণত হবে।
আমি লেখাটি শুরু করেছিলাম চিলকট রিপোর্ট দিয়ে কিন্তু শেষ করলাম আইএসের মার্কিন যোগাযোগ দিয়ে। এর কারণ হল এই বিষয়গুলো কোনটিই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্যারিস কিংবা ব্রাসেলস কিংবা ইস্তানবুলের মত আমার দেশও আজ আইএস সৃষ্টির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত। আমাদেরকে তাই জানতে হবে এসবের পছনে কারা কলকাঠি নাড়াচ্ছেন। ইরাক আগ্রাসনের ১৩ বছর পর চিলকট রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, প্রমাণিত হয়েছে এটি ছিল যুদ্ধাপরাধ। আইএস সৃষ্টি করে যারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষদের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন, তাদের স্বরূপ উদঘাটিত হতে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?