শিবলী নোমান
২০১৫ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় ও সরকার গঠনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের প্রশ্নটি সামনে এসেছে। বাবরি মসজিদের স্থানে কী হবে কিংবা দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আমরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস, শিবসেনাসহ নানা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন প্রত্যক্ষ করেছি। সম্প্রতি আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। এই খসড়া তালিকা থেকে আসামে বসবাসরত ৪০ লাখ বাংলাভাষীকে বাদ দেয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই ৪০ লাখ বাংলাভাষীর ধর্ম ইসলাম। অন্যদিকে আরেকটি মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের নাগরিকদের ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা ও জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান বিষয়ক ভারতীয় সংবিধানের ৩৫(এ) ও ৩৭০ নং অনুছেদ রদ করার চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার। উভয় ক্ষেত্রেই গণআন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে বা হওয়ার পথে রয়েছে। ইতোমধ্যেই, আসামের ঘটনার প্রতিবাদ করেছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মমতার এই প্রতিবাদ আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে নিছক রাজনৈতিক স্টান্টবাজি কিনা তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
এই মূহুর্তে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করতে চাচ্ছি তা হলো, ভারতের আসাম ও জম্মু কাশ্মীরে মুসলিম নাগরিকদের নাগরিকত্ব প্রশ্নে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা কি কেবল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের কারণে হয়েছে? নাকি এর পিছনে আরও কোন প্রভাবক কাজ করছে? আর ঠিক এই প্রশ্নের মাধ্যমেই এই সংকট ব্যাখ্যায় সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার পথ খুলে যায়। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন ১৯৯৬ সালে তাঁর ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ শীর্ষক গ্রন্থে আসন্ন ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী জাতি ও রাষ্ট্রগুলোর সংঘাতের প্রকৃতি ও মাত্রা বিষয়ে আলোচনা করে এক ধরণের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ঠান্ডা যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সংঘাতগুলো মূলত সভ্যতার সাথে সভ্যতার সংঘাত হিসেবে আবির্ভূত হবে। এই প্রস্তাবনায় ধর্ম ও আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে বিভিন্ন জাতিসত্তার পৃথকীকরণের ফ্যাক্টর হিসেবে গ্রহণ করা হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, ভারতের আসাম ও জম্মু কাশ্মীরে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সৃষ্ট জটিলতার ক্ষেত্রেও হয় ভাষা না হয় ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছে বা নাগরিকত্ব হরণের যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আসামের বাংলাভাষীরা একদিকে যেমন বাংলাভাষী, অন্যদিকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আর আসামের অন্যান্য নাগরিকের ভাষা যেমন অহমিয়া, তেমনি ধর্মও আলাদা। অন্যদিকে বিজেপি বলতে চাইছে এই ৪০ লাখ মানুষ মূলত বাংলাদেশের নাগরিক। জম্মু কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়রাও ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ২৯টি রাজ্য নিয়ে গঠিত ১৩১ কোটি মানুষের দেশ ভারতে কেন শুধুমাত্র ধর্ম ও ভাষা প্রশ্নে এমন জটিলতা দেখা দিলো। এক্ষেত্রেও আমরা উত্তরের জন্য সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের দিকে ফিরে তাকাতে পারি। এই তত্ত্বটির প্রস্তাবনায় হান্টিংটন বিশ্বব্যাপী সাতটি সভ্যতার বর্তমান থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো, সিনিক (ভাষাভিত্তিক), হিন্দু (ধর্মভিত্তিক), ইসলাম (ধর্মভিত্তিক), জাপানি, পাশ্চাত্য, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা (সম্ভাব্য)। এখানে হিন্দু সভ্যতার কোর রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যদি হিন্দু সভ্যতা বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার অবস্থানে আসে তাহলে ভারতই হবে তার কেন্দ্রবিন্দু। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাষাভাষী ২৯টি রাজ্য নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র হওয়ায় ভারত একটি ফাটলরেখার রাষ্ট্র হিসেবেও আবির্ভূত হয়। বিভিন্ন সময় ভারতের নানা রাজ্য স্বাধীনতা কিংবা আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করেছে এবং এখনও করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাম ও জম্মু কাশ্মীর রাজ্যে নাগরিকত্ব প্রশ্নে উদ্ভূত সংকট ভারতকে নতুন করে এক ধরণের জটিলতায় ফেলে দিবে যার ফলে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভেতর এক ধরণের সংঘাত তৈরি হতে পারে বা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে। সাধারণ চোখে এই সংঘাতকে নিছক সাম্প্রদায়িক বা উগ্র হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ মনে হলেও, ব্যাপকতর অর্থে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে এই সংঘাত ভারতীয় হিন্দু সভ্যতার সাথে ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের ইসলামি সভ্যতার সংঘাত হিসেবে আবর্ভূত হতে পারে। যে কোন ক্ষেত্রেই এই ফলাফল হবে রক্তক্ষয়ী ও অমানবিক।
ভারতের নাগরিকত্ব প্রশ্ন নিয়ে উদ্ভূত জটিলতার ব্যাখ্যা সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের মাধ্যমে দেয়া গেলেও, এ কথাও সত্য যে, হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। তারপরও ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সভ্যতার সংঘাতের ব্যাখ্যা ফেলে দেয়া যায় না। সভ্যতার সংঘাত হোক কিংবা নিছক সাম্প্রদায়িকতা, যে কোন ক্ষেত্রেই এর মূল্য দিতে হবে ভারতের সাধারণ জনগণকে, এ বিষয়টি যত দ্রুত ভারতীয় সাধারণ জনগণ বুঝতে পারবেন ততই মঙ্গল।