শিবলী নোমান
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ, ২৩ বছরের বৈষম্য ও নীপিড়নের চূড়ান্ত অধ্যায় হিসেবে বাংলাদেশীদের উপর পাকিস্তানি বাহিনী যখন অপারেশন সার্চলাইট নামক হত্যা ও নিধনযজ্ঞে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকার নো-ম্যানস ল্যান্ডের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। পিছনে ফেলে আসা ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নিজেকে বাঁচাতে তিনি ভারতে প্রবেশ করতে পারতেন একজন সাধারণ শরণার্থী কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে। কিন্তু মানুষটি তখন ব্যক্তিচিন্তার ঊর্দ্ধে উঠে গিয়েছেন, অনেক উপরে। এজন্যে আগেই নিজে ভারতে প্রবেশ করলেন না। বরং নিজের দুইজন প্রতিনিধি পাঠালেন ভারত সীমান্তে এই জানিয়ে যে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্তে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি অপেক্ষায় আছেন। ভারত যদি যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে তাকে গ্রহণ করতে পারে তাহলেই তিনি ভারতে প্রবেশ করবেন। ভারত মানুষটির শর্ত মেনেই তাকে গ্রহণ করেছিল। মানুষটি তাজউদ্দীন আহমদ, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অনেকটাই নিঃসঙ্গ সেনাপতি।
আগেই বলেছি ঐ সময়টায় তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগত চিন্তাগুলো থেকে নিজেকে অদ্ভুতরকম আলাদা করে ফেলেছিলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে নিজের পরিবারকে বাঘের থাবার মুখে রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে তাকেই সবকিছুর হাল ধরতে হবে, তাই তার গ্রেফতার হওয়া চলবে না। পাকবাহিনী সে রাতে এসেছিল তাজউদ্দীনের খোঁজে, কিন্তু দূরদর্শী তাজউদ্দীন তার আগেই নিজের গন্তব্যে ঠিক করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিচিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরেও। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কোলকাতার ৮, থিয়েটার রোড অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারের অফিস ছেড়ে এক রাতও তিনি কাটান নি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে। এক সেট কাপড় পরে কাটিয়েছেন পুরোটা সময়, সেই কাপড় ধুয়েছেন নিজেই। ঈদের দিন ঈদ পালন না করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরেছেন। যুদ্ধের পর নিজ এলাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যতদিন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সবার ঘর-বাড়ি আবার নতুন করে না উঠবে ততদিন তার পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে না।
ব্যক্তিগত চিন্তাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখলেই যে সব কাজ সহজ হয়ে যায় না তা জানতেন তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু তিনি কি জানতেন কতটা ষড়যন্ত্রময় সময়ের হাল ধরেছেন তিনি? তিনি কি জানতেন কতটা সর্পিল সময়ের বাঁক ধরে এগিয়ে যাবেন তিনি সেই নয়টি মাস? মুক্তিযুদ্ধকে কিছু বইতে পড়ে আমরা যতটা সরল মনে করি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে তার চেয়েও হাজার গুন জটিল ছিল তা আমাদের বুঝতে হবে। আর এই সব জটিলতার ভার সবচেয়ে বেশি বহন করতে হয়েছে তাজউদীন আহমদকে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারংবার; মুজিব বাহিনীর গঠণ ও এর নেতাদের সাথে বিরোধ; আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আস্থা অর্জন; তরুন নেতাদের বিপ্লবী কাউন্সিল গঠণ কিংবা সেক্টর কমান্ডারদের ওয়ার কাউন্সিল গঠণের প্রস্তাব; সব উত্থান-পতন তিনি সামাল দিয়েছেন দক্ষ হাতে। শুধু তাই নয়, মুজিবনগর মন্ত্রীসভায় থাকা খন্দকার মোশতাকের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা তিনি সামাল দিয়েছেন এমনভাবে যেন মোশতাক গংদের উদ্দেশ্য পূরণ না হয় আবার বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের আভ্যন্তরীন বিরোধ দৃশ্যমান না হয়। সকল ক্ষেত্রেই তাজউদ্দীন ছিলেন একজন দক্ষ ও সফল কুশীলব।
স্বাধীনতার পরও তাজউদ্দীন আহমদ ভুলে যান নি কোন কিছুই। তিনি জানতেন তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে। তাই বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার সাথে সাথে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশের হাল ধরেছিলেন। তাজউদ্দীন আসলেই কিছু ভুলে যান নি। ভুলে যান নি বলেই বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে বিদ্রুপ করতে ছাড়েন নি। ম্যাকনামারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তাই ম্যাকনামারা যখন তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে কী সহায়তা চায়, বিদ্রুপ করে তাজউদ্দীন বলেছিলেন বাংলাদেশের দরকার গরুর দড়ি আর গরু যা বিশ্বব্যাংক দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে। এই তাজউদ্দীনকেই ম্যাকনামারা পরবর্তীতে তৎকালীন সময়ের অন্যতম সেরা অর্থমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করেছিলেন। এখানেই তাজউদ্দীন আহমদের সার্থকতা।
তাজউদ্দীন আহমদ শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি বিষয়কেই শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন নি। তিনি ধরে রেখেছিলেন বাংলাদেশের সময়কেও। ঘড়ির কাঁটার হিসেবে ভারত বাংলাদেশের স্থানীয় সময় থেকে আধা ঘন্টা পিঁছিয়ে থাকলেও যুদ্ধের নয় মাস ভারতে অবস্থানকালে তাজউদ্দীন তাঁর হাতঘড়ির সময় পরিবর্তন করেন নি। তাঁর ঘড়ি ও তিনি অনুসরণ করতেন বাংলাদেশের সময়। বাংলাদেশের সময় ধরেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা ভুলে গিয়েছি। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্যের। আরো বড় দুর্ভাগ্য এই যে আমরা ভুলতে বসেছি তাজউদ্দীন আহমদকেও। মহান মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারী তাজউদ্দীন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সহকর্মীদের বলতেন, “আসুন আমরা দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করি যেন ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকেরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।” তাজউদ্দীন আহমদ যেই অর্থেই এই কথা বলে থাকুন না কেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করা হবে। আর বর্তমান বাস্তবতায় তাজউদ্দীন আহমদের মত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের প্রয়োজন অনেক অঙ্কে বেশি তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।
২৩ জুলাই, ক্ষণজন্মা এই নেতার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তাজউদ্দীন, ভুলে যাওয়া মহানায়ক!