শিবলী নোমান
গত জুন মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই থেকে দেশব্যাপী যা ঘটে গেলো তা এক কথায় অগ্রহণযোগ্য। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষার্থী অবান্ধব খামখেয়ালি আচরণ, পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা-অগ্নিসংযোগ-ধ্বংসযজ্ঞ, বহু নিরপরাধ নাগরিকের নিহতের ঘটনার পাশাপাশি যে প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে তা হলো, শিক্ষার্থীদের একটি শান্তিপূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলনের এমন সহিংস পরিণতির দায় কি বাংলাদেশ সরকার এড়িয়ে যেতে পারে?
এটি স্পষ্ট যে, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনটি এমন সহিংস রূপ নিবে তা ভাবনার বাইরে ছিল। কিন্তু এটিও স্পষ্ট যে, জুন মাস থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের প্রথম দিকে সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা যায় নি। সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি ‘আদালতে বিচারাধীন’, আর তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না, এই অবস্থানেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। অথচ শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করেও এই একই বক্তব্য উপস্থাপন করা যেত, কারণ বিচার বিভাগে সরকার ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অবস্থান একই ছিল। উভয় পক্ষই ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছিল।
অন্যদিকে, এই আন্দোলন নিয়ে আইনমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর চেয়ে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীকে আমরা অধিক হারে মন্তব্য করতে দেখেছি। একই সময়ে চলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন সংক্রান্ত আন্দোলনেও কোন এক অজানা কারণে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ সেতুমন্ত্রীর সাথে দলীয় কার্যালয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। যেহেতু সেতুমন্ত্রী একই সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক, তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের স্থলে সকল বিষয়ে তার মন্তব্য ও আলোচনা রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে।
একই সাথে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ১১ জুলাইয়ের পর তারা মূলত গণসংযোগ ও প্রচারণামূলক কার্যক্রমেই তাদের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কতিপয় সাংবাদিকের তোষামদে পূর্ণ প্রশ্ন ও মন্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কিছু মন্তব্যের কারণে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুনরায় রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও অপমানিত বোধ করেন।
এতকিছুর পরও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় না বসে ১৫ জুলাই সেতুমন্ত্রী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ছাত্রলীগের প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়ে পুরো পরিস্থিতিটিকে ঘোলাটে করে ফেলেন। একই দিন দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায়। অথচ এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের বহু নেতা-কর্মী শুধু সক্রিয়ভাবে অংশই নেন নি, নেতৃত্বও দিচ্ছিলেন। এভাবে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানোর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো পুরোপুরি অনিরাপদ হয়ে ওঠে।
এসময় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনও পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতিবাচক পদক্ষেপ না নিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকে। ১৬ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনার মাধ্যমে দেশের সকল পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার ফলেই ১৭ জুলাই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তাহীনতায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় পরের দুই দিন এই আন্দোলন ক্যাম্পাসগুলোর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে-পরে শিক্ষার্থীসহ বহু নাগরিক নিহত হওয়ায় আন্দোলনটি ক্রমশ সহিংস হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাস্থ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে হামলা-অগ্নিসংযোগ-ধংসযজ্ঞের গতিপ্রকৃতি থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পক্ষ থেকেও এসব কর্মকাণ্ডের সাথে তাদের আন্দোলনের অসম্পৃক্ততার কথা জানান হয়। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোন কারণ ছিল না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি আন্দোলন তৈরি হলে, নানা মহল সেই আন্দোলনটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটিই স্বাভাবিক। আর এই সাধারণ বিষয়টি সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দেরও অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আন্দোলনটিকে গুরুত্ব না দিয়ে ও না দেখার চেষ্টা করে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি অসংবেদনশীলতা প্রদর্শন করেছে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষার্থীদেরই মুখোমুখি করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইউজিসি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর মাধ্যমে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তার ফলেই, অন্তত সরকারের ভাষ্য মতে, অন্যের পক্ষে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটির দখল নেয়া সম্ভব হয়েছে।
অর্থাৎ, দেশের জনগণের কোন অংশকেই গুরত্ব না দেয়া, তাদের ন্যায্য-অন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি সংবেদনশীল আচরণ না করা, সরকার ও দলের ভেতর দৃশ্যমান পার্থক্য না থাকা এবং সর্বোপরি খুব সহজেই সকলকে সরকারের প্রতিপক্ষ ভেবে বসার মানসিকতা থেকেই দেশে এত প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেলো। নোয়াম চমস্কি তাঁর ফেইলড স্টেটস গ্রন্থে ব্যর্থ রাষ্ট্রের যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলেন, তার ভেতর একটি হলো এসব রাষ্ট্রের সরকার তার নিজের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারে না। চমস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে বৈশিষ্ট্যগুলো বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকারেরও কি বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত নয়?