শিবলী নোমান
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো নানা কারণেই বেশ মজার একেকটি স্থান, আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও এর ব্যতিক্রম নয়। এই ক্যাম্পাসে কোন আন্দোলন শুরু হলে ক্ষণে ক্ষণে যেভাবে তার রূপ-গুণ, দাবি-দাওয়া ও বিবদমান পক্ষগুলোর রদবদল ঘটে, তা নিয়ে বিদ্যায়তনিক গবেষণা হতে পারে। কিন্তু ক্যাম্পাসের যে বিষয়টা বেশ মজার তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মোটাদাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ ইতিহাসের ভেতর থেকে বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনাকে মূল্যায়ন করেন না। এর জন্য তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করাও জরুরি নয়, তবে এ কথা বলা হয়তো একেবারে ভুল হবে না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন ঘটনাকে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত বছরের অতীত ইতিহাসের আলোকে বিচার করে থাকেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনই মূলত উপরোক্ত প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপলক্ষ্য। এই আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন ঘটনা যেভাবে ডাল-পালা মেলেছে এবং আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিকে নিত্য পরিবর্তন করেছে, তার ভেতর গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের বাইরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়ালচিত্র মুছে তার উপর আন্দোলনরত একটি ছাত্র সংগঠনের ধর্ষণবিরোধী দেয়ালচিত্র অঙ্কন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এহেন আচরণকে অনেকেই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তথা ছাত্রলীগের প্রতি উসকানিমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, আপাত বিবেচনায় যা মোটেই অসত্য নয়। আবার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর চিত্র মুছে ফেলার বিষয়টিকে জাতির জনকের অবমাননা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। তবে পুরো বিষয়টিতে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতাকে লালন করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
মনে পড়ে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দেয়ালে জাতির জনকের এক বিশাল চিত্র আঁকা হয়েছিল, জানি না সেটি এখনো আছে কিনা বা থাকলেও কী অবস্থায় আছে। তবে যারা সেই দেয়ালচিত্রটি এঁকেছিলেন, সেই দলে আমার কাছের বন্ধুও থাকায় দারুণ তৃপ্তি বোধ করেছিলাম, এখনো করি। কিন্তু নতুন কলা ভবনস্থ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত দেয়ালচিত্র মুছে ফেলার ঘটনাটির বিরুদ্ধে যেরূপ সরল বয়ান তৈরির প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, তার সাথে একমত হওয়া আসলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীতে অবস্থান নেয়ার শামিল, ফলে বিপজ্জনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের যে স্থানে উক্ত দেয়ালচিত্রটি ছিল, স্মৃতি ঘাটলে দেখা যাবে ২০১৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে চলমান আন্দোলনের সময় ঠিক সেই স্থানে দিনের আলোতে একটি ক্যারিকেচার এঁকেছিলেন সেই সময়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সেই ক্যারিকেচারটি শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের বাস্তবতায় নানাভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল না, বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক যুগের শিক্ষক রাজনীতির সিলসিলার এক দারুণ রূপায়নও ছিল। তবে সেই সময়ের আন্দোলনটি কিছুটা থিতু হওয়ার খুব অল্প সময়ের ভেতর মুজিব শতবর্ষকে উপলক্ষ্য করে সেই ক্যারিকেচারটির উপর হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত দেয়ালচিত্রটি আঁকা হয়েছিল, যার ফলে আগের ক্যারিকেচারটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে নেয়ার কোন উদ্দেশ্য ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন সামনে আসতে পারে।
তবে উপলক্ষ্য যাই হোক, কিছুদিন যাবত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমতের প্রকাশ হিসেবে দেয়াল লিখন ও দেয়ালচিত্রগুলো কণ্ঠরোধ করার জন্য এহেন বিরোধী লিখন বা চিত্রের উপর বঙ্গবন্ধু বা বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্কিত দেয়ালচিত্র এঁকে দেয়া বা কিছু লিখে দেয়া বেশ সাধারণ একটি প্রবণতা হিসেবে সামনে এসেছে। কারণ বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র মুছে তার উপর অন্য যে কোন চিত্রাঙ্কন বা দেয়াললিখনকে খুব সহজেই জাতির জনকের অবমাননার দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়।
এক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ হলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনেই বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বিশাল দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। আর এটিও স্বীকার করতেই হয় যে এই ছবিটি খুব দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। এই ছবিটির নিচে এর আগে যে দেয়ালচিত্র ছিল তাতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় নামক যন্ত্রে প্রবেশ করে ‘সহমত ভাই’ বলতে উচ্চকিত একটি যান্ত্রিক শ্রেণিতে পরিণত হয়। সেই দেয়ালচিত্রের ঠিক নিচেই ছিল ২০১৭ সালে অপর এক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কাঁঠাল ও গাছের ডাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগের এক ব্যাঙ্গাত্মক দেয়ালচিত্র। এর উপরে ছিল ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হওয়া জুবায়ের আহমেদের হত্যাকারীদের বিচারের দাবির দেয়ালচিত্র, নিহত জুবায়ের আহমেদের ছবিসমেত।
অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে ও উদ্ভূত নতুন বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো সর্বদাই নতুনরূপে সামনে এসেছে, আবার নতুন কোন দাবির মুখে পরিবর্তিতও হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর যে দৃষ্টিনন্দন দেয়ালচিত্রটি রয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম প্রয়োজনেও বঙ্গবন্ধুর অবমাননার অভিযোগের দায় ব্যতিরেকে কি সেখানে অন্য কিছু করা যাবে?
উত্তরটি হলো যাবে না। যাবে না কারণ এমনটি করা হলে কী পরিণতি হতে পারে সেটিও এখন আমাদের সামনে একেবারে স্পষ্ট। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে প্রাসঙ্গিকতা না হারানো দেয়াললিখন বা দেয়ালচিত্রের উপর নতুন করে দেয়ালচিত্র এঁকে দেয়া বা দেয়াললিখনের ভেতর বিষয়টি আর সীমাবদ্ধ নেই। যদিও ইতিমধ্যেই আলোচ্য দেয়ালটিতে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর একটি দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে। কিন্তু সেই দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর পূর্বের দেয়ালচিত্রটি মুছে নতুন দেয়ালচিত্র অঙ্কনের অপরাধে গত ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এই দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি মুছে নতুন দেয়ালচিত্র অঙ্কনের বিষয়টি নিয়ে অনেকগুলো বয়ান-প্রতিবয়ান-ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি হওয়ার বিষয়টিকে কিংবা এর ফলে চলমান ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের লাভ-ক্ষতির হিসাবকে একপাশে রেখে এটি এখন স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর ছবি, তর্জনী বা উক্তি ব্যবহারের বিষয়টি আশঙ্কা থেকে বাস্তবে পরিণত হলো।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও প্রতিবাদ করেছিলেন, রাজপথে নেমেছিলেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি নান্দনিক ভাস্কর্য স্থাপনের আলোচনাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের ভেতর আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবে পরিণত হয় নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্রটি মুছে ফেলার বিষয়টিকে শিক্ষকদের একটি অংশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হিসেবে দেখানোর চেষ্টাও করা হয়েছে, সরল বিশ্বাসে করা হলেও এই চেষ্টাকে সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদটির ভুল ব্যাখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। অথচ ড্রেনের ঠিক উপরে, ছাত্রদের শৌচাগারের ঠিক পাশের একটি দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র আঁকা শোভনীয় হয় কিনা, একবারের জন্যও আমরা তা ভাবার প্রয়োজন মনে করি নি। তাহলে কি নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহারের প্রশ্নটিকে একেবারে বাতিল করা যায়?
এই যে নিজ স্বার্থরক্ষায় ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে একটি সস্তা মাধ্যমে পরিণত করার প্রচেষ্টা, দ্ব্যর্থহীন চিত্তে তার বিরোধিতা করা প্রয়োজন। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আমার শক্তির উৎস”। কিন্তু যাদের নানাবিধ হীনকর্মের ফলে বঙ্গবন্ধুকে আজ একটু একটু করে তাঁর শক্তির উৎস তথা দেশের সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের জন্যই আহমদ ছফা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস-এর একেবারে শুরুতেই লিখেছিলেন, “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।” আর এরূপ স্বার্থান্বেষী মহলের দাপুটে উপস্থিতির বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর ক্ষুদ্র ভক্ত হিসেবে বলার থাকে সেই পুরনো বুলিই, “যেই মুজিব জনতার, সেই মুজিব মরে নাই। যেই মুজিব জনতার, সেই মুজিব মরে না।”
প্রথম প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি’২৪; পরিবর্ধিত প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি’২৪।
আপনার লেখাটা দারুণ। বিশেষত আপনার প্রথম প্যারার সাথে একত্ব ঘোষণাই করছি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকে পাঠ করার একটা বিষয় আছে, এবং তার জন্য পুস্তক আছে, কিন্তু পাঠক নেই। এর ফলে সুযোগটা আসলে শিক্ষকেরা পান। এবং আমরা তাই দেখতে পাই, প্রতিটি আন্দোলনে।