শিবলী নোমান
১০ ও ১১ নভেম্বর, ২০১০; বুধ ও বৃহস্পতিবার
অবশেষে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক নম্বর টার্মিনাল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। উদ্দেশ্য সূর্যোদয়ের দেশ জাপান গমন, সফরটা ১৫ দিনের। যদিও পাঁচ মাস আগে এই সফরের বিষয়ে কল্পনাও করি নি আমি।
আমাকে বিমানবন্দরে বিদায় এসেছিল আমার বাবা-মা, ছোট বোন তামান্না, ছোট ফুপি আর ছোট ফুপি মেয়ে আরেক ছোট বোন মালিহা। অর্থাৎ পুরো বাঙালিয়ানা কায়দায় আমাকে বিদায় দেয়া হয়েছে একটু আগে। যদিও আমি মাত্র ১৫ দিন পরই ফেরত আসছি তবে মাঝে কোরবানির ঈদ থাকায় এবং এই প্রথম পরিবারকে রেখে একেবারে দেশের বাইরে একটি ঈদ কাটাবো বলে হয়তো পরিবারের সবাই একটু বেশি উদ্বিগ্ন। কিন্তু বিষয়টা এমন না হলেও হয়তো আমার পরিবারের সবাই আমার সাথে বিমানবন্দর পর্যন্ত আসতো। এটাই আমাদের সংস্কৃতি তো, বন্ধনটাই এমন।
যাই হোক, এখন আমি ঠিক টার্মিনাল এক-এর ভেতর ঢুকে আমার লাগেজ চেকিং-এর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে আছে জাফর ভাই। সূচনা আপু এখনো পৌঁছেনি কিন্তু জাফর ভাই তাড়াহুড়া করে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়েছেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তা ভেতরে ঢুকতেই আমাদের পাসপোর্ট আর টিকেট দেখলেন আর আমাদের লাগেজ স্ক্যানিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিলেন। যেই মাত্র আমার লাগেজ স্ক্যান করা শেষ হয়েছে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বললেন আবারও স্ক্যান করতে। তারা আবার আমার মূল লাগেজ স্ক্যান করলেন এবং জানতে চাইলেন এর ভেতর কাপড় ছাড়া কী আছে। আমি বললাম পোস্টার আর দুইটি ক্রেস্ট আছে। তারা বললেন লাগেজ খুলে দেখাতে। জীবনে প্রথমবার বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকেছি, প্রথমবার দেশের বাইরে যাচ্ছি আর এমন সময় যদি নিরাপত্তা মনে করেন যে লাগেজে অবৈধ কিছু আছে তখন যে অনুভূতিটা হয়, তা হলো অপমানের অনুভূতি। সেই অপমানকে চাপা দিয়ে লাগেজ খুললাম। ভেতর থেকে দুইটা ক্রেস্ট ছাড়া কিছুই তারা পেলেন না। বললেন এই ক্রেস্টগুলোকেই স্ক্যানিং মেশিনে স্বর্ণের মনে হচ্ছিলো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো! আমি একজন নিরীহ মানুষ আর আমি নাকি স্বর্ণ চোরা-কারবারির সাথে যুক্ত!
যাই হোক, সিকিউরিটি চেকিং শেষ করে বোর্ডিং পাশ নিতে নিতে আমাদের সাথে সূচনা আপুও যোগ দিলেন। এসেই নিচু স্বরে আমার কাছে কিছুটা বিষোদগার করলেন হাতে সময় থাকার পরও তাকে ছাড়া ভেতরে ঢুকে যাওয়ায়। জাফর ভাইয়ের উপর সব দোষ চাপিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেইটে চলে আসলাম। ফ্লাইটের তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। এদিক-সেদিক হাটাহাটি করলাম, বিমানবন্দরের ভেতরের ডিউটি ফ্রি শপগুলোতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। এরপর বসে থাকলাম নির্ধারিত গেইটে প্লেনে ঢোকার অপেক্ষায়। এর ভেতর সূচনা আপু তার বাসায় কথা বলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি আমার বাসায় কথা বলতে চাই কিনা। আমি মানা করলাম। এরপর সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমাদেরকে প্লেনে ওঠার জন্য বলা হলো। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিমানে প্রবেশের সময় অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমি একটা বেল্টের ভিতর দিয়ে প্লেনে ঢুকে গিয়েছি, কোন্ প্লেনে যাচ্ছি তার কিছু না জেনেই। তখনো জানতাম না বেশির ভাগ বিমানে এভাবে বেল্টের মাধ্যমেই ঢুকতে হয়। আমি ভেবেছিলাম সিনেমায় যেমন দেখা যায় তেমন বা প্রধানমন্ত্রী যেমন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন তেমন হবে ব্যাপারটা।
এই বিমান আমাদেরকে প্রথমে নিয়ে যাবে সিঙ্গাপুর। সেখানে চার ঘণ্টা ট্রানজিটের পর একটি কানেকটিং ফ্লাইটে আমরা যাবো জাপান। বিমান সময়মতো তার উড়ান শুরু করলো। বিমান যখন উপরে উঠতে থাকলো তখন খেয়াল করলাম আমার মাথা কেমন জানি ঝিমঝিম করছে আর কান ব্যথা করছে। খুব খারাপ লাগতে শুরু করেছে। আমার পাশেই জানালার পাশের আসনে সূচনা আপু বসা। তাকে কিছু বলতেও পারছি না লজ্জায়। কিছুক্ষণ পর সব ঠিক হয়ে গেলো। ততক্ষণে বিমান আকাশে ভাসছে। সিঙ্গাপুরের সুন্দরী বিমানবালারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছে। তারাই আমাদেরকে মটর ভাজা খেতে দিলো। সিঙ্গাপুরের কারো সাথে এটাই আমার প্রথম সাক্ষাৎ, আর প্রথম সাক্ষাতেই মটর ভাজা!
এই ফ্লাইটটা প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে সিঙ্গাপুরের সময়ের পার্থক্যের কারণে ঘড়িতে সময় পার হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। কিছুক্ষণ পর বিমানের ইকোনমি ক্লাসের ভেতর সবগুলো আলো জ্বলে উঠলো আর সবাইকে খাওয়া দেয়া শুরু হলো। আমাকে একজন বিমানবালা জিজ্ঞেস করলেন আমি চিকেন নিতে চাই না ফিশ, মানে মাছ। আমি ভাবলাম চিকেন খাওয়াই তো ভালো। বললাম চিকেন দিতে। বলার পর সেই বিমানবালা আমাকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের একটা প্যাকেট দিয়ে দিলো। কিন্তু প্যাকেট খুলে আমি এ কী দেখতে পেলাম! এটা কি চিকেন নাকি! কেমন যেন হালকা রঙের মসলার ভিতর কিছু একটা চুবিয়ে রাখা হয়েছে। কষ্ট করে একবার মুখে দিয়ে দেখলাম। স্বাদ পুরো বিতিকিচ্ছিরি! বড় মামা বলেছিলেন খুব ভালো খাওয়া দেয় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে। তাই মামাকে কিছু গালাগাল করতে করতে না খেয়ে বসে থাকলাম। তখনো জানতাম না বিমানে চাইলেই আইসক্রিম বা পানীয় পাওয়া যায়। তাহলে কষ্ট করে না খেয়ে থাকা লাগতো না।
খাওয়ার পর সবাইকে হেডফোন দিতে থাকলো বিমানবালারা। বিমানে ওঠার পরই সকল ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বন্ধ করতে বলে এখন হেডফোন বিলি করাটা কেমন ফাযলামি বুঝতে পারলাম না। মেজাজ খারাপ লাগছিলো। আরো মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো এটা দেখে যে অনেকে হেডফোন নিচ্ছেও। মেজাজ ভালো করার জন্যে ভাবলাম ঘুমাবো।
ঘুম ভাঙলো বিমানের ক্যাপ্টেনের গলার স্বরে। বিমান ল্যান্ড করতে যাচ্ছে, সবাইকে সিটবেল্ট বেধে নেয়ার জন্য বলা হলো। সিটবেল্ট পরে বিমান ল্যান্ডিঙের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলাম। বিমান ল্যান্ড করলো সিঙ্গাপুর চাঙ্গি বিমানবন্দরে। বিমান থেকে এবারও বেল্ট দিয়ে এয়ারপোর্টের গেইটে প্রবেশ করলাম। কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে কিছুই জানি না। শুধু জানি চার ঘণ্টা পর আরেকটি বিমানে উঠতে হবে, তাই ঠিক করলাম যত কিছুই হয়ে যাক, জাফর ভাইয়ের পিছে পিছে থাকবো। কারণ আমাদের তিনজনের ভেতর শুধুমাত্র তারই বিদেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আছে, তাও অনেকবার।
চাঙ্গি বিমানবন্দর বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দর। এর আয়তন ১৩ বর্গ কিলোমিটার যা আমাদের শাহজালাল বিমানবন্দরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। এতে তিনটি টার্মিনাল রয়েছে যেগুলো নির্মিত হয়েছে ১৯৮১, ১৯৯০ ও ২০০৮ সালে। এখন কাজ চলছে চতুর্থ টার্মিনাল নির্মাণের, যা ২০১৭ সালের ভেতর কাজ শুরু করার কথা। এই বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিন একশোরও বেশি বিমান সংস্থার বিমান ৮০টি দেশের ৩০০ শহরে তাদের উড়ান পরিচালনা করে। প্রতি সপ্তাহে এই বিমানবন্দরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বিমান আসা যাওয়া করে।
আমাদের বিমান যে টার্মিনালে ল্যান্ড করেছিল, আমাদের পরের ফ্লাইট সেই টার্মিনালে ছিল না। তাই নতুন টার্মিনালে যাওয়ার জন্য যখন পথ খুঁজছিলাম, তখন জানতে পারলাম এখানে এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যেতে হয় ট্রেনে। বিমানবন্দরের ভেতর টার্মিনাল থেকে টার্মিনালে যেতে আলাদা ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। একে তো এত বড় বিমানবন্দর, তার উপর এসব কারবার দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো। কোন্টা ছেড়ে কোন্টা দেখবো বুঝতে পারছিলাম না। আমরা আমাদের পরের ফ্লাইটের টার্মিনালে চলে আসলাম। এখানে বিমানবন্দরের ভেতর গাড়ি চলছে, হাজার হাজার মানুষ বসে আছে, ওদিকে সিঙ্গাপুরে রাত শেষে শুরু হচ্ছে নতুন আরেকটি দিন।
আমরা হাঁটতে থাকলাম। দেখতে থাকলাম চাঙ্গি বিমানবন্দর। সব সময় হাঁটাও লাগছিল না। হাঁটতে ক্লান্তি লাগলে হাঁটাপথের পাশেই এস্কেলেটর মতো কিছু একটা রয়েছে কিছুক্ষণ পর পর, আপনি শুধু দাঁড়াবেন, আর সেটি নিজেই আপনাকে কিছুদূর এগিয়ে দিবে। দেখে মনে হচ্ছিলো এটি কোন বিমানবন্দর নয়। এ যেন কাঁচে ঘেরা কোন শহর। এখানে হাজার হাজার ডিউটি ফ্রি শপে দৈনন্দিন প্রয়োজনের সবকিছু পাওয়া যায়। যেন আপনি চাইলে এখানেই আপনার ঘরবাড়ি বানাতে পারবেন! জায়গায় জায়গায় টেলিফোন বুথ প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। কিছুক্ষণ পর পর দিক-নির্দেশক আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছে আপনি কোথায় আছেন আর আপনার গন্তব্যস্থল কোথায়, কতদূরে। স্থানে স্থানে এক ধরনের অদ্ভুত চেয়ার পাতা। দেখলেই বুঝা যায় খুবই আরামদায়ক। আরো আশ্চর্যের বিষয় হল এসব চেয়ারে যারাই বসে আছেন, তারা ঘুমাচ্ছেন, দেখার ভুল হতে পারে, হয়ত ঘুমাচ্ছেন না কিন্তু চোখ বন্ধ করে আছেন। আর চেয়ারের নিচে পা রাখার জায়গায় তার রেখে দেয়া দুই পা কোন এক যন্ত্রের সাহায্যে নড়াচড়া করছে। অর্থাৎ এক্সারসাইজ! কাছাকাছি গিয়ে দেখতে চাইলাম যে চাইলেই সবাই এসব চেয়ারে বসে আরাম করে এক্সারসাইজ করতে পারেন কিনা। কিন্তু না, এটি বিনামূল্যের সেবা নয়। এখানে প্রতি দশ মিনিট বসে থাকার জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ সিঙ্গাপুরি বা মার্কিন ডলার। হতাশ হয়ে গেলাম কিছুটা। ফ্রি হলে একবার চেষ্টা করা যেত।
হাঁটতে হাঁটতে সূচনা আপু ক্লান্ত হইয়ে গেলেন। আমরা তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে আবার হাঁটতে থাকলাম। কারণ জাফর ভাইয়ের দুইটা জিনিস দরকার ছিল। প্রথমত, সিগারেট খাওয়া; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ফোন করা। আমরা প্রথমেই স্মোকিং জোনে চলে গেলাম। কাঁচে ঘেরা বিমানবন্দরের এক পাশে ছোট ছোট কাঁচের দরজা, আর দরজার ওপাশেই স্মোকিং জোন। সেখানে এক ভয়াবহ অবস্থা! চারদিকে শুধু ধোঁয়া আর সবার হাতে নয়তো মুখে সিগারেট। তবে স্মোকিং জোনগুলোও দারুণভাবে সাজানো, আপনি চাইলে বসে থাকতে পারেন, ছোট ছোট বেঞ্চ পাতা আছে। চাইলে দাঁড়িয়েও থাকতে পারেন। আপনি সিগারেট খাবেন বলে আপনাকে কষ্ট করে খেতে হবে তা নয়। শুধু নন স্মোকিং জোনে সিগারেটটা খাওয়া যাবে না, এই আর কী! জাফর ভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি সিগারেট শেষ করে এখান থেকে বের হতে। তিনি আমাকে বললেন, “ওয়েট, ইয়ং ম্যান, দিস ইজ লাইফ!”
যাই হোক, অনেক কষ্টে সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম ফোন করতে। এর আগে অবশ্য জাফর ভাইয়ের কিছু মানি এক্সচেঞ্জ করতে হয়েছে ফোন করার জন্য। ফোনে একটি কয়েন দিয়ে ছয় মিনিট পর্যন্ত কথা বলা যায়। জাফর ভাই তার বাসায় কথা বললেন দেড় মিনিটের মতো। এরপর বললেন আমি যেন আমার বাসায় ফোন করি, কারণ অনেক সময় বাকি আছে ছয় মিনিট শেষ হতে। ফোন করতে গিয়ে দেখি আর কোন কল যাচ্ছে না। বুঝলাম ছয় মিনিট কথা বলা যাবে কিন্তু তা একটি নাম্বারেই, একবারেই। হতাশ হয়ে গেলাম একটু, কারণ আমার কাছে সিঙ্গাপুরী কয়েন ছিল না আর জাফর ভাইয়ের কাছে আর চাইতেও পারছিলাম না। তবে ভরসা ছিল যে জাফর ভাইয়ের বাসা থেকে আমাদের সব খোঁজ-খবর আমার বাসায় পেয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমার বাসার মানুষ সিদ্ধহস্ত!
আমরা এরপর আবারও হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম বিমানবন্দরটা। জানালা দেখিয়ে জাফর ভাই বললেন, “সিঙ্গাপুর দেখে নাও, দেশে গিয়া বলতে পারবা।” আমি সিঙ্গাপুর দেখলাম। সিঙ্গাপুরে তখন মাত্র ভোর হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পানির পিপাসা পেয়েছিল। জাফর ভাই একটা দোকান থেকে এক কাপ কফি নিলেন। আমরা সেটা ভাগ করে খেলাম আর এক বোতল পানিও কেনা হলো। আমরা ওয়াটারকে পানি বলায় দোকানের মহিলা কর্মী মজা করে দু’বার ‘পানি’ বলে হেসে দিলেন। পানি খেয়ে আমরা কিছুটা পানি সূচনা আপুর জন্য রেখে দিলাম। এরপর ফিরে গেলাম যেখানে সূচনা আপুকে বসিয়ে রেখে এসেছিলাম।
সূচনা আপু আবারও আমাদের উপর একটু মেজাজ খারাপ করেছে, বুঝলাম তাকে এতক্ষণ একা একা বসিয়ে রাখার কারণে। তাকে পানি খাইয়ে শান্ত করে আমরা আমাদের বিমানের জন্য নির্ধারিত গেইটের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। কারণ আমাদের পরের ফ্লাইটের জন্য গেইট খুলে দেয়া হয়েছিল। একটু শীত শীত লাগছিলো তাই ওভারকোট গায়ে চাপালাম। ওভারকোটটার হাতা আমার প্রয়োজনের চেয়ে একটু ছোট, কারণ ওভারকোটটা বড় মামার কাছ থেকে ধার করা।
আমরা আবারও বিমানে প্রবেশ করলাম। এবার আমাদের সিট পড়েছে একদম মাঝের সারিতে। আর এই ফ্লাইট প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা দীর্ঘ। এতক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকতে হবে ভেবেই কেমন জানি লাগছিল। এই ফ্লাইটেও আগের ফ্লাইটের সেই জঘন্য খাওয়া দেয়ায় মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেলো। বুঝলাম জাপানে না নামা পর্যন্ত তেমন কিছুই খাওয়া হচ্ছে না আমার। বসে থাকতে থাকতে হাত-পা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল, তাই উঠে কিছুক্ষণ বিমানের ভেতর হেটে এসে আবার বসে নিজের আসনে পড়লাম।
অবশেষে লম্বা আকাশ ভ্রমণটা শেষ হলো। সময়ের তারতম্যের কারণে আমরা আগের দিন রাত দশটায় বাংলাদেশের বিমানবন্দরে প্রবেশের পর থেকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা কাটিয়ে জাপানের নারিতা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। নারিতা বিমানবন্দরের আরেক নাম টোকিও নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি জাপানের দ্বিতীয় প্রধানতম ও ব্যস্ততম বিমানবন্দর। ১৯৬০ এর দশকে জাপানের হেনাদা বিমানবন্দরের উপর থাকা অত্যাধিক চাপ কমাতে টোকিও শহরের পাশে চিবা শহরে এই বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই বিমানবন্দরেও আলাদা তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই বিমানবন্দরে পাঁচটি রানওয়ে ছিল। শুধু যাত্রীবাহী বিমানই নয়, এই বিমানবন্দর দিয়ে প্রচুর পরিমাণ কার্গো বিমান যাওয়া আসা করে।
প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশন পার হয়ে আমরা আমাদের সবগুলো লাগেজ সংগ্রহ করে নিলাম। পুরো সময় আমি জাফর ভাইয়ের পেছন পেছন থাকলাম যেন হারিয়ে না যাই। জাপানের মানুষ খুব একটা ইংরেজি বলতে পারে না, সেটা ছিল আরেকটা নতুন ভয়, কারণ আমি জানতাম মাত্র দুইটি জাপানি শব্দ। মিজু মানে পানি আর মেগান মানে চশমা! জাফর ভাইয়ের সাথে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখলাম হলুদ রঙের জ্যাকেট পরা ঈষৎ সোনালী চুলের একটি কম বয়সী মেয়ে রেড ক্রস আঁকা বড় কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে চশমা, মাথায় একটা স্টাইলিশ টুপি যেখানে অনেকগুলো কোটপিন লাগানো। বুঝলাম সে আমাদেরকেই খুঁজছে। আমরা গিয়ে তার সাথে কথা বললাম। আমার কাছে মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো কোন স্কুলের ছাত্রী হবে হয়তো। যদিও সে ছিল অনেক লম্বা, কিন্তু তার চেহারা দেখে বয়স বেশ কমই মনে হচ্ছিলো। সে তার নাম বলল ইয়োশিকো মানাবে, আর সে একজন ল্যাঙ্গুয়েজ ভলান্টিয়ার। অর্থাৎ জাপানিদের হয়ে আমাদের সাথে ইংরেজিতে যোগাযোগ করার দায়িত্বটা আপাতত তার। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম আমাদের সাথে আফগানিস্তানের ডেলিগেশনেরও একসাথে টোকিও যাওয়ার কথা, কিন্তু তারা তাদের লাগেজ হারিয়ে ফেলায় তাদের দেরি হবে।
এই ফাঁকে আমরা মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙিয়ে জাপানি ইয়েন নিলাম। আমি একশো ডলার ভাঙালাম। আমার কাছে সব মিলে তিনশো ডলার ছিল। আর যা মানি এক্সচেঞ্জ করে যে কয়েন পেয়েছিলাম, তা দিয়ে ঢাকায় ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আমরা জাপান পৌঁছে গিয়েছি। এরপরই জাপান রেড ক্রসের একজন লোক আমাদের হাতে একটা করে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন এটাই আমাদের রাতের খাবার এবং আমাকে বললেন, “তুমি এগুলো খেয়ে মজা পাবে, এখানে চকোলেট আছে।” আমি জানি চকোলেট আমার প্রিয়, কিন্তু ঐ ভদ্রলোক কি আমাকে বাচ্চা মনে করে এই কথা বললেন কিনা আমি বুঝতে পারলাম না।
এরপর তারা আমাদেরকে একটি বাসে উঠালো, আর জাপান রেড ক্রসের একজন আমাদের সাথেই উঠলো। এই বাস আমাদেরকে টোকিও নিয়ে যাবে। এটি ছিল বিমানবন্দর থেকে টোকিও যাওয়ার একটা নিয়মিত বাস। তখন জাপানে রাত প্রায় নয়টা। আমাদের হোটেল ছিল টোকিও প্রিন্স হোটেল, সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেলো। আমি রাস্তার দুই পাশে জাপান দেখতে থাকলাম। যদিও রাতের অন্ধকারে বিমানবন্দর থেকে টোকিওর হোটেলে যাওয়ার পথে খুব বেশি কিছু দেখার ছিল না। এক সময় রাস্তার দুই পাশে সারি সারি রাস্তাই শুধু দেখা যাচ্ছিলো, কখনো কিছু ছোট ছোট পাহাড়। মূল টোকিও শহরে ঢুকে যাওয়ার পর চোখে পড়তে শুরু করলো রাস্তার দুই পাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এর সারি। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাসে কাটিয়ে আমরা আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম।
হোটেলে আমাদেরকে স্বাগত জানালো জাপান রেড ক্রসের কর্মকর্তা রিকা উয়েনো। রিকা গড়পরতা জাপানি মহিলা, গায়ের রঙ ফর্সা, তবে চোখ অন্য জাপানিদের চেয়ে বেশ বড় বড়। জাফর ভাই তাকে আগে থেকেই চিনতেন, তাই তারা নিজেদের ভেতর আড্ডা ও মজা করা শুরু করলেন। জাফর ভাই ঢাকা থেকে রিকাসহ অন্যান্য পূর্বপরিচিতদের জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলো তাদের দিয়ে দিলেন।
এই সময় হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি ‘টিক টিক’ ‘টিক টিক’ আওয়াজ হওয়া শুরু করলো। ঠিক সিনেমায় বোমা ফাটার আগে যেমন আওয়াজ হতে থাকে। সবাই একটু ভয় পেয়ে গেলো। আর আমি দেখলাম হোটেলের কিছু লোক আমার লাগেজের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। তখনই বুঝলাম যে কোনভাবে আমার লাগেজের ভেতর থাকা টেবিল ঘড়ির অ্যালার্ম বাজতে শুরু করেছে। লজ্জার মাথা খেয়ে তাড়াতাড়ি লাগেজ খুলে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিলাম। এরপর আমাকে আমার রুমের চাবি দেয়া হলো। রুম নম্বর ৫৭৯।
আমার রুমমেট ছিল ইন্দোনেশিয়ার একজন। নাম দেস্তেরানা জালু। জালুর পর আরেকটা অংশ আছে নামের, সেটা উচ্চারণ করতে পারলাম না। সে তখনো আসেনি। তাই বুঝলাম জাপানে প্রথম রাত আমাকে একাই রুমে কাটাতে হবে। গোসল করে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম কমলা রঙের আলোতে জ্বলজ্বলে এক টাওয়ার। পরে জানতে পেরেছিলাম এটা টোকিও টাওয়ার। জাপানের তখন পর্যন্ত সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার, যদিও এর চেয়ে উঁচু একটির নির্মাণকাজ তখন চলমান ছিল।
ততক্ষণে আমার অনেক ক্লান্ত লাগছিল। কিছু চকোলেট আর চিপস খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সাথে সাথেই ঘুম।
Pingback: টোকিও টাওয়ার থেকে (কিস্তি ০২)