শিবলী নোমান
আমরা যারা বাংলা ভাষায় রচিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পড়তে পছন্দ করি বা করতাম তাদের কাছে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী রচয়িতা হিসেবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার খুবই পরিচিত একটি নাম। এই লেখার বিষয়ে যখন ভাবছি তখন থেকেই স্যারের লেখা একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর কথা মনে পড়ছে। ঐ গল্পটিতে দেখা যায় যে, ভবিষ্যতের কোন এক সময় মানব সভ্যতা এতটাই উন্নত হয়েছে যে, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে মানুষকে নিজের স্মৃতিতে আর কিছু মনে করে রাখতে বা জমা করে রাখতে হয় না। একটি সেন্ট্রাল নেটওয়ার্কে মানবজাতির জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য জমা করা আছে, যাকে একটি অতি-বৃহৎ ডাটাবেইজ বলা যায়। আর প্রতিটি মানুষ সেই নেটওয়ার্কের সাথে সর্বদা যুক্ত এবং যে কোন দরকারে এই নেটওয়ার্ক মানুষকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত। এর ফলে মানুষের জীবন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কে স্মৃতি ধারণ করে রাখা বা কোন তথ্য স্মরণে রাখার প্রয়োজনীয়তা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তবে এক রাতে কোন এক অজানা কারণে সেই নেটওয়ার্কটি অকেজো হয়ে পড়ে এবং ঠিক সেই সময়ই মানববসতিতে অগ্নিকান্ড ঘটে। সেই সময় সেখানে থাকা মানুষেরা সবাই দমকল বাহিনী কিংবা এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে সাড়াপ্রদান করবে এমন কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হয় কারণ তাদের স্মৃতিতে ঐসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় কোন তথ্য ছিল না। বিশেষ ঐ নেটওয়ার্কের উপর এমন আত্মঘাতী নির্ভরতার কারণে গল্পটি শেষ হয় অতি উন্নত মানব সভ্যতার পতনের মাধ্যমে, অথবা সবকিছু আবার শূন্য থেকে শুরুর অপেক্ষাকৃত শুভ সমাপ্তির মাধ্যমে।
সম্প্রতি আরেকটি বিদেশি বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পড়ে থাকতে পারে। এতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি তার ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে বাড়িতে থাকা পর্যন্ত সকল কাজ একটি মিথষ্ক্রিয়া করতে সক্ষম বা ইন্টারঅ্যাকটিভ সফটওয়্যারের মাধ্যমে করে থাকে। অফিসে যাওয়ার সময় তার বাসার দরজাটি লকও হয় ঐ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। একদিন ঐ ব্যক্তি দাঁতের চিকিৎসা করে বাড়ি ফেরার পথে আর কোনভাবেই নিজের বাসার দরজা খুলতে পারেন না কারণ তার বাসার দরজা খোলার জন্য তার ভয়েজ রিকগনিশন মোড ব্যবহার করা হয়েছে ঐ সফটওয়্যার ব্যবহার করে, আর দাঁতের চিকিৎসাজনিত ব্যথার ফলে তার কন্ঠস্বরে কিছুটা পরিবর্তন চলে আসাতেই এই বিড়ম্বনা। মূলত বিজ্ঞাপনটি একটি তালার বিজ্ঞাপন যেখানে উন্নত প্রযুক্তির নেতিবাচকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে অনেকটা ‘আদিমই উত্তম’ জাতীয় একটি বার্তা প্রচার করা হয়।
গত দুই দশকে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি যে গতিতে সামনে এগিয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে, তাতে আজকের দিনটি থেকে আগামীকালের দিনটি মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ হিসেবে সামনে আসছে। কম্পিউটারের প্রাযুক্তিক উন্নয়নের মাঝামাঝি পর্যায়ে বলা হতো প্রতি ১৮ মাসে কম্পিউটার প্রসেসরের ক্ষমতা দ্বিগুন হয়েছে উন্নততর গবেষণার ফলে। আর প্রাথমিক কম্পিউটারগুলোর আকার যে বিশাল কক্ষের সমান ছিল এবং সেগুলোর মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার জন্য বৃহৎ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের প্রয়োজন হতো তা বলা বাহুল্য হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয় কারণ এখন সেই কম্পিউটারগুলোকেই আমরা আমাদের পকেটে নিয়ে ঘুরছি। আমাদের কাছে থাকা একেকটি স্মার্টফোন আর কিছুই নয় বরং একেকটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং যন্ত্র যা আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত সহজ করে তুলছে। আমাদের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে যাতায়াত, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে তথ্যের চাহিদা পূরণ, গবেষণাকর্ম থেকে শুরু করে বিনোদন, আমরা যেভাবে চাই সেভাবে একে ব্যবহার করতে পারি। লিও টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিসের মতো বৃহৎ আকারের উপন্যাস পড়তে এখন আর লাইব্রেরিতে যেতে হচ্ছে না বা বহন করতে হচ্ছে না সেই ভারী বইটি, বরং বিভিন্ন সফটওয়্যার তথা অ্যাপসের মাধ্যমে আমাদের স্মার্টফোন বা ই-বুক রিডার ব্যবহার করে পড়ে নেয়া যাচ্ছে এগুলো।
১৯৯৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়রন রিভস ও ক্লিফোর্ড ন্যাস তাঁদের রচিত দ্য মিডিয়া ইকুয়েশন শীর্ষক গ্রন্থে গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দাবি করেছিলেন যে, একজন মানুষ অপর একজন মানুষের সাথে যেভাবে যোগাযোগ করে, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলোর সাথেও ঠিক একইভাবে যোগাযোগ করে। অর্থাৎ মানুষের ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো নিতান্তই যন্ত্র সে বিষয়টি মানুষ সচেতন মনে জেনে থাকলেও, ঐ একই মানুষের অচেতন মনটি ঐ যন্ত্রকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করে। যেসব গবেষণা করে এই ত্তত্বটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই, তবে এই বিষয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলে কৌতুহলী পাঠক বেশ মজাদার কছু তথ্য খুঁজে পাবেন। যোগাযোগ অধ্যোয়নে এই তত্ত্বটি পঠিত হয়, যদিও এর অনেকগুলো সমালোচনা আছে।
আমরা যদি খুব সচেতনভাবে খেয়াল করি বা নিজেকে প্রশ্ন করি তাহলে কিন্তু এটুকু তথ্য পাওয়া খুব কঠিন নয় যে, আমাদের সাথে থাকা স্মার্ট ফোন বা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটগুলোকে আমরা মানুষের মতো বিবেচনা না করলেও নিদেনপক্ষে আমাদের একাকীত্বের সাথী, বিনোদনের খোড়াক এবং জীবনধারনের জন্য প্রায় অপরিহার্য বলেই মেনে নিয়েছি। এর সাথে যে কোন তথ্যের জন্য ইন্টারনেট নির্ভরতার বিষয়টি যুক্ত হয়ে মানুষের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রাযুক্তিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে এখন ইন্টারঅ্যাকটিভ রোবট নিয়ে কাজ হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এসব রোবট হয়ত হবে ঠিক আমাদের মনের মতো। যেখানে সারাজীবনে আমরা অনেক সাধনা করেও আমাদের মনের মতো একজন মানুষ পাই না, সেখানে মনের মানুষ খোঁজার বিষয়টি আগামীতে নাও থাকতে পারে। বিষয়টি অস্থির মানবমনে শিহরণ জাগাতে পারে, কিংবা আতঙ্ক!
অন্যদিকে আমাদের কাছে এখন এমন অনেক ইন্টারঅ্যাকটিভ সফটওয়্যার ও গ্যাজেট চলে এসেছে যার ফলে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যই আমাদের আর কষ্ট করে মস্তিষ্কে জমা রাখতে হচ্ছে না, আমাদের হয়ে ঐ যন্ত্রগুলোই তা করে দিচ্ছে। একটু পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে, আপনার কাছের কতজন মানুষের মোবাইল ফোন নম্বর আপনার মুখস্ত আছে। সংখ্যাটি খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ১৫ থেকে ২০ বছর আগেই হয়ত এই মানুষগুলোর ফোন নম্বর আপনার মুখস্ত ছিল। অন্তত আমার ক্ষেত্রে কাছের মানুষের ফোন নম্বর মনে রাখার গ্রাফটি নিম্নমুখী। আর যে নতুন প্রজন্ম বর্তমান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সময়েই জন্ম নিচ্ছে তাদের কাছে তথ্য মস্তিষ্কে জমা রাখার বিষয়টি বোঝানো সম্ভব হবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও বিষয়টি সম্ভবত হবে কষ্টসাধ্য।
নতুন নতুন প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনকে সহজ করে দিচ্ছে। এর ফলে মানুষ তার ক্ষুদ্র জীবনের মূল্যবান সময়গুলো তুলনামূলক অপ্রয়জনীয় কাজে ব্যয় না করে গঠনমূলক কাজে লাগাতে পারছে। রিভস ও ন্যাসের মিডিয়া ইকুয়েশন তত্ত্ব সত্য হলেও খুব বেশি সমস্যা হিসেবে সামনে আসে না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির উপর আমরা কতটা নির্ভর হবো তা নির্ধারণ করার সময় সম্ভবত খুব বেশি দূরে নেই। নাহলে এই প্রযুক্তি আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে লেখার শুরুতে বলা সেই কল্পকাহিনীটির মতোই। ‘আদিমই উত্তম’ এমন বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান থাকতেই পারে, সে নিয়ে ভিন্ন আলোচনাও হতে পারে। কিন্তু যে মানব সভ্যতা আজকের অবস্থানে এসেছে মানব মস্তিষ্কের ব্যবহারের মাধ্যমে, সেই মস্তিষ্কের ধীরে ধীরে কর্মহীন হয়ে পড়াটা প্রকৃতি খুব সহজে মেনে নেবে, তা মনে করা বোকামিও হতে পারে।
(রচনাকাল: ২০১৯)