শিবলী নোমান
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম নিয়ে পড়ালেখা করায় এবং বছর কয়েক আগেও প্রথাগত অর্থে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী থাকার অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় প্রায়ই মনে পড়ে। সাংবাদিকতা সম্পর্কিত বিভাগগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠ্যক্রমে এক বা একাধিক কোর্স থাকে সংবাদ সম্পাদনা বিষয়ক। এই কোর্সগুলোতে সংবাদ সম্পাদনার একেবারে প্রাথমিক বিষয়াদি থেকে শুরু করে সংবাদ প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত একজন সহ-সম্পাদক বা সাব-এডিটর যে কাজগুলো করে থাকেন, সেসব বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাদানের চেষ্টা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে একজন প্রতিবেদকের তৈরি করা প্রতিবেদনে শিরোনাম দেয়ার কাজটিও সহ-সম্পাদকের অন্যতম কাজ হিসেবে উল্লিখিত হওয়ায়, শিরোনামের বিভিন্ন ধরণ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার পাশপাশি বিভিন্ন সংবাদের সূচনা বা ইন্ট্রো থেকে শিরোনাম নির্ধারণের কৌশল সম্পর্কে শিক্ষাদানের একটি চেষ্টাও এই কোর্সগুলোতে থাকে। আর তাই এই কোর্সগুলোতে অংশ নেয়ার সময় বিভিন্ন সংবাদের শিরোনাম প্রদান নিয়ে হাতে-কলমে নিয়মিতই কাজ করতে হতো। আর দেখা যেত, সংবাদের শিরোনামের গৎবাঁধা ধরণ, শব্দচয়ন ও গাম্ভীর্যের প্রকৃতির বাইরে এসে যারা একটু অন্য ধরনের, অনেকটা ‘আউট অব দ্য বক্স’ শিরোনাম প্রদান করতে পারতো, দিনশেষে সেটিই শিক্ষকদের নজরে পড়তো বেশি।
এ পর্যায়ে বলে নেয়া ভালো হবে যে, জানা মতে সম্পাদনা ও উচ্চতর সম্পাদনা বিষয়ক কোর্সগুলো এখনো আমাদের সাংবাদিকতা বিভাগগুলোতে পড়ানো হয়। তবে এ ধরনের কোন কোর্সে পাঠদানের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রতিবেদন বা সংবাদের শিরোনাম নিয়ে শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের বর্তমান ভাবনা সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।
তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগসমূহের সম্পাদনা বিষয়ক কোর্স কিংবা আদতে সংবাদের শিরোনাম নিয়ে আলোচনার পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একটি দুঃখজনক আত্মহত্যার ঘটনা। ফেইসবুক লাইভে এসে কথা বলার এক পর্যায়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন আবু মহসিন খান নামের একজন ব্যবসায়ী, যিনি সম্পর্কের দিক থেকে জনপ্রিয় ও সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত চিত্রনায়ক রিয়াজের শশুর।
আবু মহসিন খানের এভাবে আত্মহত্যার তথ্য ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির পরিচয় হিসেবে এসব সংবাদের শিরোনাম ও মূল সংবাদে প্রাধান্য পায় চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর হিসেবে আবু মহসিন খানের পরিচয়টি। পরবর্তী সময়ে আবু মহসিন খানকে তার মেয়ের স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত করার ব্যাপারটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও অন্যত্র নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়, এবং এই মুহূর্তে এই আত্মহত্যার সাথে সম্পর্কিত সর্বশেষ কিছু সংবাদের শিরোনামে ‘চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর’-এর পরিবর্তে ‘ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান’ লিখতে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল আলোচনাটি বা সমালোচনাটি সম্ভবত এটিই ছিল যে, সংবাদমাধ্যমগুলোর একজন মানুষকে কেন অমুক বা তমুকের শ্বশুর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে? তার তো নিজের পরিচয় আছে, আছে পেশাগত পরিচয়ও, সেসব পরিচয় কেন মুখ্য হয়ে উঠলো না সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে? আবার যেহেতু জনমতের চাপেই হোক বা সম্পাদকীয় নীতিমালার পরিবর্তনের ফলেই হোক, মেয়ের স্বামীর সাথে যুক্ত পরিচয়টি দূরে রেখে আবু মহসিন খানের ব্যক্তিগত বা পেশাগত পরিচয়েই এখন তাকে সংবাদগুলোতে পরিচিত করিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাহলে কি প্রথম দিকে ‘চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর’ হিসেবে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা সংবাদ মাধ্যমগুলোর পেশাগত ভুল চর্চা ছিল?
শেষ প্রশ্নটিই মূলত এই লেঝার আলোচ্য। যার উত্তর খুঁজতে হলে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বোঝার পাশাপাশি মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেও বোঝাপড়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এ কথা সত্য যে, যে কোন সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম প্রদানের মূল উদ্দেশ্যই হলো ঐ সংবাদটি সম্পর্কে পাঠককে আকৃষ্ট করা, পাঠককে ঐ সংবাদটি পাঠের উদ্দীপনা সরবরাহ করা। কিন্তু তারপরও তো একজন পাঠক দিনের সংবাদপত্রের প্রতিটি সংবাদ পড়েন না, অনলাইন পোর্টালের সকল বিভাগের সকল সংবাদ পড়েন না। এক্ষেত্রে পাঠকের আগ্রহের পাশাপাশি সংবাদের প্রকৃত সংবাদ মূল্য ও অন্যান্য উপাদানই একটি ঘটনাকে অন্যান্য সমরূপী ঘটনা থেকে আলাদা করে তুলে ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়।
এক্ষেত্রে এটিও মনে রাখতে হয় যে, একটি সংবাদ হিসেবে একটি ঘটনার গুরুত্ব ঐ ঘটনায় সংবাদের কয়টি উপাদান যুক্ত আছে তার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে। একজন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার সংবাদটি ততক্ষণ পর্যন্ত একটি আত্মহত্যারই ঘটনা, যতক্ষণ না এর সাথে চিত্রনায়ক রিয়াজকে যুক্ত করা হলো। চিত্রনায়ক রিয়াজের সাথে আত্মহত্যাকারীর আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত হওয়ায় সংবাদটিতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন একজন জনপ্রিয়, কিংবা নিদেন পক্ষে একজন আলোচিত ‘পাবলিক ফিগার’, যা আবার পাঠকের দিক থেকে সংবাদটির প্রতি নৈকট্য বা ‘প্রক্সিমিটি’-কেও উসকে দিচ্ছে। অর্থাৎ, একটি আত্মহত্যার ঘটনা, যাকে বহু পাঠকের কাছেই হয়তো নিত্যদিনের ঘটনা মনে হতে পারে, চিত্রনায়ক রিয়াজের নামটি যুক্ত হয়ে যাওয়ায় তা হয়ে উঠে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম একট সংবাদ। কারণ যে পাঠকের আত্মহত্যা বা ব্যবসায়ী সম্পর্কে আগ্রহ নেই, তার আগ্রহ থাকতেও পারে একজন অভিনেতা বা চিত্রনায়ক সম্পর্কিত বিষয়াদির প্রতি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ নিহত হন, একেবারে নিয়ম করে এ বিষয়ে রোজ সংবাদও প্রকাশিত হয়। কিন্তু গতকাল বা গত সপ্তাহে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কত জন ও কারা কারা নিহত হয়েছেন, সংবাদের পাঠক হিসেবে আমরা অনেকেই তা বলতে পারবো না। বহু পাঠক সাধারণ হয়ে যাওয়া এসব সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ এখন আর আদৌ পড়েন কিনা, তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে, যতক্ষণ না এর সাথে আরো বেশি মর্মান্তিকভাবে যুক্ত হয়ে যায় তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনীরের মতো কারো কারো নাম।
যুগের পর যুগ ধরে সংবাদের উপাদান হিসেবে এই প্রক্সিমিটি, প্রমিনেন্স নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছে। চর্চা হয়ে আসছে। সেই দিক থেকে ভাবলে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের দুঃখজনক এই আত্মহত্যার ঘটনাটিকে অন্যান্য আত্মহত্যা থেকে আলাদা করেছে মূলত দুইটি বিষয়। এর প্রথমটি নিশ্চিতভাবেই চিত্রনায়ক রিয়াজের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক। দ্বিতীয়টি হলো ফেইসবুক লাইভে থাকা অবস্থায় তার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার ঘটনা। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, কিছুদিন আগে রিয়াজের কান্নার ভিডিওই কিন্তু ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যা নিয়ে হয়েছে ট্রল-মিম। তাহলে এই ঘটনার পর থেকে এই আত্মহত্যা নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা পাঠকমহল ও সামাজিক মাধ্যমে হয়েছে, চিত্রনায়ক রিয়াজের উল্লেখ এসব সংবাদে না থাকলে তা কি আদৌ হতো? এই প্রশ্নটি থেকেই যাবে।
প্রশ্নটি থেকে যাবে কারণ এর সঠিক বা সঠিকতার কাছাকাছি উত্তর দিতে হলে যে ধরনের গবেষণালব্ধ তথ্য প্রয়োজন, আমাদের সাংবাদিকতার পেশাগত এলাকায় শুধু নয়, সাংবাদিকতা সম্পর্কিত বিদ্যায়তন বা অ্যাকাডেমিয়ায়তেও সে ধরনের গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতির কথা কাউকে পীড়া দিলে বলতে হবে, যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণা অন্তত নেই। আমাদের গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের পাঠক-শ্রোতা-দর্শক তথা অডিয়েন্স আসলে কোন আধেয় বা সংবাদগুলো পড়ছে, কেন পড়ছে, অডিয়েন্স বিহেভিয়ার, নিউজ কনজাম্পশন নিয়ে আমাদের গবেষণামূলক কাজের পরিমাণ অত্যল্প। আর গবেষণালব্ধ তথ্যের অভাবের কারণেই আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছে দিনের পর দিন, সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট থেকে ভুল না করেও বাধ্য হচ্ছে অপরাধীর মতো শিরোনাম ও সংবাদের ভেতরের শব্দচয়ন বদলে দিতে।
কিন্তু এই ঘটনায় চিত্রনায়ক রিয়াজের নাম উল্লেখ কি আসলেই অনিবার্য ছিল? সংবাদমাধ্যমের কাজ সংবাদ প্রকাশ করা, পাঠক যা জানতে চান তা নিজ উদ্যোগে খুঁজে জেনে নিবেন, এমন ভাবনা আমাদের মনে বা মাথায় আসতেই পারে। এক্ষেত্রে দায়টা সংবাদমাধ্যমগুলোও কি পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারে? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিটি সংবাদমাধ্যম নিজেদেরকে জনগণের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং করে। কিন্তু এই সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার যে দিনশেষে একটি ব্যবসা ও পেশা, যা দিয়ে বহু মানুষের সংসার চলে, তা প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমকে ‘মসীহা’ ভাবার ‘মিস্টিসিজম’ থেকেও পাঠককে বের করে আনা জরুরি, যার শুরুটা করতে হবে সংবাদ মাধ্যমগুলোকেই, ধীরে হলেও। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের পুঁজি বা মুনাফা কী করে আহরিত হয়, তা নিয়ে রাখঢাকের প্রয়োজন তো নেই। এই সংবাদে চিত্রনায়ককে যুক্ত করার প্রধান কারণ তো এর ভেতরই নিহিত! নাকি ভুল বলা হলো?
এটি দুঃখজনক যে, যেখানে আমাদের আলোচনা করার কথা ছিল এমন আত্মহত্যা কেন হয়, কিংবা সমাজের উপর এভাবে সামজিক মাধ্যমে লাইভ করে আত্মহত্যার ঘটনার বিরূপ প্রভাব নিয়ে, সেখানে সাংবাদিকতার মানদণ্ডে বলার মতো কোন অপরাধ না করেও, সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে হয়ে যাওয়া পাবলিক ট্রায়াল নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন ভাবা জরুরি খুবই আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলা সামাজিক মাধ্যমে ‘ট্রলিং’ মানসিকতা নিয়ে; অন্যদিকে ভাবা জরুরি সামাজিক মাধ্যমে আমাদের আচরণের প্রবণতা নিয়েও। মিডিয়া লিটারেসি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এটিও জরুরি যে, চর্চার ক্ষেত্রে গুণগত মান বজায় রাখলে জনমতের ভুল চাপে নতি স্বীকার না করা, অন্তত নতিস্বীকারের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা।
কিন্তু ভুলে ভরা গণমাধ্যম, উটকো অনলাইন পোর্টাল এবং সংবাদমাধ্যমের নাম ভাঙিয়ে নানা ধরনের অনৈতিক ও অপেশাদার চর্চাগুলো বর্তমান রেখে আমাদের প্রকৃত সংবাদমাধ্যমগুলো কি সেই সৎ সাহস দেখানোর অবস্থায় আদৌ আছে?
(রচনাকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২২)