শিবলী নোমান
একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে তা নিশ্চিত। কিন্তু বাল্যবিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজও যে খুব একটা সঙ্কুচিত হয়নি তাও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ইউনিসেফের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ এখনো বাল্যবিবাহের সংখ্যা ও মাত্রার দিকে থেকে বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের ভেতর রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে তিন কোটি ৮০ লাখ শিশু যারা বাল্যবিবাহের শিকার, এর ভেতর এক কোটি ৩০ লাখের বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগেই। এসব হিসাবকে খুব বেশি ভয়াবহ মনে না হলে শরণাপন্ন হওয়া যায় ইউনিসেফেরই একই প্রতিবেদনের আরেকটি তথ্যের। যেখানে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ নারীদের ৫১ শতাংশ তাদের বয়স ১৮ পূরণ হওয়ার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসেন, অর্থাৎ শিকার হন বাল্যবিবাহের।
বাল্যবিবাহ যে কোন অর্থেই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোন নতুন চর্চা নয় তা স্পষ্ট। তবে বিশ্বব্যাপী করণা মহামারী কিংবা অতিমারীর কারণে বাল্যোবিবাহ নিয়ে আবারও কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও আমাদের দেশের মতো দেশগুলোতে, যেখানে বাল্যবিবাহ এখনো প্রচলিত এবং রাষ্ট্রীয় আইন কিংবা নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েও খুব বেশি সুবিধা করা যাচ্ছে না, সেখানে বাল্যবিবাহ সবসময়ই কোন না কোন মহলের আলোচনায় থাকে এ কথাও সত্য। তবে চলমান করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী নতুন করে বাল্যবিবাহ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেইভ দ্য চিলড্রেন-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ২০২০ সালে সাধারণ হিসাবের প্রায় পাঁচ লাখ বেশি শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হতে যাচ্ছে করোনাকালে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। এছাড়া সাধারণ সময়ের চেয়ে ১০ লাখ কন্যা শিশু গর্ভবতী হতে যাচ্ছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হিসেবে আগামী পাঁচ বছরে সাধারণ হিসাবের চেয়ে ২৫ লাখ বেশি কন্যা শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হতে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন কোন সমস্যা না হলেও করোনাকালীন বাস্তবতার ফলে অর্থনৈতিক কারণে দেশে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির আশঙ্কা বাতিল করা যায় না। তবে ২০১৭ সালে নতুন করে প্রণীত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন থেকে শুরু করে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর মাধ্যমে শুধুমাত্র ২০২০ সালেই সাড়ে তিন হাজারের অধিক বাল্যবিবাহ রোধের তথ্য আমাদের একদিক থেকে স্বস্তি দিলেও, দেশের বাল্যবিবাহের চলমান প্রবণতা ও করোনাকালে বৈশ্বিক প্রবণতার সাথে তাল রেখে দেশের ভেতর বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির আশঙ্কা আগের স্বস্তিকে অনেকটাই উল্টে দেয়। তাছাড়া বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি চলমান উদ্যোগগুলো যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় তা ইউনিসেফের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। কারণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি পূরণ করতে হবে ২০৩০ সালের ভেতর, যেখানে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ অন্যতম। এছাড়া ২০৪১ সালের ভেতর দেশ থেকে বাল্যবিবাহ দূরীকরণের জাতীয় লক্ষ্যও রয়েছে। এই সময়সীমার ভেতর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের লক্ষ্যপূরণে বর্তমান সময় পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। তাছাড়া করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির প্রবণতা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে নতুনভাবে ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করা স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ও মাত্রা অনেক বেশি হলেও আমাদের গণমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে খুব বেশি উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগগুলোর পর্যাপ্ত প্রচারও আমরা আমাদের গণমাধ্যমে দেখতে পাই না। অথচ গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে প্রিন্ট সাংবাদিকতা ‘বুম’ বা বিস্ফোরণ এবং এই শতাব্দীর শূন্য দশকে সম্প্রচার সাংবাদিকতার বিস্ফোরণের কথা আমরা তৃপ্তির সাথে বলি। এর সাথে বর্তমান দশকের শুরুর দিক থেকে অনলাইন সাংবাদিকতার ব্যাপক প্রচলন, সামাজিক মাধ্যম ও ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহারও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বাল্যবিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন পক্ষেই খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এর মানে এই নয় যে তারা কাজ করছেন না, বরং বলতে চাওয়া হচ্ছে যে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তাদের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোকে আরও বেশি ছড়িয়ে দিয়ে আরও বেশি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।
এক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যমগুলোর সদিচ্ছা নিয়েও আলোচনা জরুরি। বৈধ হোক বা অবৈধ, এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের গ্রামাঞ্চলগুলোতে ক্যাবল টেলিভিশন পৌঁছে গিয়েছে। তাই দেশের জনগণের একটি বড় অংশ এখন প্রিন্ট ও সম্প্রচার মাধ্যমের সান্নিধ্যে রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে, যদিও শ্রোতা-পাঠক-দর্শক বা অডিয়েন্সের মিডিয়া লিটারেসি কিংবা অভিরুচি নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা ও পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কিন্তু এসব বিষয়কে আপাতত প্রাথমিক চিন্তায় না এনে আমাদের গণমাধ্যমগুলো যদি নিজেদের সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে নিজেরাও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতো বা নেয়, তাহলে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতো বা পাবে। দিনশেষে আমাদের গণমাধ্যমগুলো আসলেই গণমানুষের কাজে লাগবে। এসব কার্যক্রম গ্রহণে গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত মহলের সদিচ্ছা ছাড়া আর খুব বেশি কিছু প্রয়োজন বলেও মনে হয় না।
১৯৪৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট এম. হাচিন্সের নেতৃত্বাধীন হাচিন্স কমিশন বা কমিশন অন দ্য ফ্রিডম অব দ্য প্রেস তাদের তৈরিকৃত প্রতিবেদনে গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা গণমাধ্যমের হাতেই অর্পণ করে গণমাধ্যমগুলোকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্যে বলেছিল। অর্থাৎ বলা হয়েছিল গণমাধ্যমগুলোকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হতে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে যদি জানতে চাওয়া হয় যে, বিদ্যমান স্বাধীনতার ভেতর আমাদের গণমাধ্যমগুলোর যতটুকু সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করা সম্ভব, তা কি তারা করছে? স্বীকার করি বা না-ই করি, এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হলো প্রধানত বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু বাল্যবিবাহের মতো গণমাধ্যমের জন্যে ‘ইজি টু ক্র্যাক’ একটি বিষয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা কি আসলেই খুব কঠিন? ছোট ছোট ভিজ্যুয়াল কিংবা টেক্সচুয়াল কনটেন্ট তৈরি করে প্রচার করা কি আসলেই খুব কঠিন? দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে, দেশের কন্যাশিশুদের ভবিষ্যতের স্বার্থে আমাদের গণমাধ্যমগুলো কি এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারে না? যদি এমন হয়ে থাকে যে বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই গণমাধ্যম ব্যবহারে সচেতন নয়, সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো কি নিজে থেকে এগিয়ে এসে বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বয় করতে পারে না?
নাকি সব দায় বিটিভি ও বেতারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমরাই ‘বাম্পার ফলন’-এর সংবাদ নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতেই বেশি আগ্রহী?
(রচনাকাল: ডিসেম্বর, ২০২০)