শিবলী নোমান
গত ২৮ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড. তৌফিক জোয়ার্দারের জনস্বাস্থ্যমুখী সাংবাদিকতা ও অতিমারিকালের অভিজ্ঞতা শীর্ষক লেখাটি দৃক নিউজে প্রকাশিত হয়। একজন জনস্বাস্থ্যবিদ হিসেবে অতিমারির সময়ে গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা কিংবা এমন পরিস্থিতিতে দেশের গণমাধ্যমগুলোর কীভাবে কাজ করা উচিত ছিল, কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল, ড. তৌফিক তাঁর লেখায় মূলত সেদিকেই আলোকপাত করেছেন। বর্তমান লেখাটি মূলত ড. তৌফিকের লেখাটির একটি প্রতিক্রিয়া, কোন কোন বিচারে প্রতিবয়ানও হতে পারে।
শুরুতেই এটি বলে নেয়া ভালো হবে, নিজের লেখায় ড. তৌফিক অতিমারিকালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর করণীয় হিসেবে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, মোটাদাগে তার কোনটির সাথেই দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর বিদ্যমান বাস্তবতায় গণমাধ্যমকর্মীরা সেভাবে কাজ করবে, কিংবা করতে পারবে, এমনটা ধরে নেয়াই আসলে ত্রুটিপূর্ণ। গণমাধ্যমগুলো আসলে কীভাবে তাদের নিত্যদিনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট বোঝাপড়া না থাকলে দুই দিক থেকে ভুল বোঝার একটি শঙ্কা থেকে যায়। ড. তৌফিকের লেখাটিও সেই শঙ্কার বাইরে নয়। সে কারণেই ড. তৌফিকের লেখাটির সূত্র ধরেই দুইটি বিষয়ে সম্পূরক আলোচনা জরুরি মনে হয়।
প্রথমত, লেখার শেষ দিকে ড. তৌফিক উল্লেখ করেছেন, “অতিমারির প্রায় দুই বছর পর আজ বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অনেক গুণগত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।” শুধুমাত্র এই বাক্যটি পড়ে এটি নিশ্চিত হওয়া বেশ সমস্যাপূর্ণ যে, ড. তৌফিক আসলে গণমাধ্যমের কোন দিকে গুণগত পরিবর্তনের কথা নির্দেশ করেছেন। তবে, যেহেতু তিনি তাঁর পুরো লেখা জুড়ে অতিমারিকালে সংবাদকর্মীদের কাকে-কীভাবে-কী প্রশ্ন করা উচিত ছিল, কোন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ কিংবা তথ্য উদঘাটন করা প্রয়োজন ছিল সেসব নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাই এটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে তিনি এসব ক্ষেত্রেই দেশের গণমাধ্যমের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়নের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে বর্তমান লেখকের জন্য দেশের গণমাধ্যমের গুণগত পরিবর্তন সাধিত হওয়ার তথ্যটি নানাবিধ কারণেই আনন্দদায়ক। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ড. তৌফিকের লেখা থেকে যে ধরনের গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যযায়, তা সাধিত হওয়ার বাস্তবতাই এই মুহূর্তে দেশের গণমাধ্যমগুলোর নেই। সদিচ্ছা বা ক্ষমতা নেই তা নয়, বরং বাস্তবতা নেই। অর্থাৎ, বিদ্যমান বাস্তবতার কারণে সদিচ্ছা বা ক্ষমতা থাকলেও, তা প্রদর্শনের সুযোগ সাধারণ সংবাদকর্মীদের নেই।
রাষ্ট্রীয়, কাঠামোগত ও আভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদকর্মীদের কাজ করার ক্ষেত্রে ড. তৌফিক যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, অতিমারিকালে একজন জনস্বাস্থ্যবিদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ আসতে পারে না। কিন্তু একজন সংবাদকর্মী কি চাইলেই সেভাবে সংবাদ তৈরি করতে পারেন? সঠিক স্থানে সঠিক প্রশ্ন করার যে কথা ড. তৌফিকের লেখায় স্পষ্ট, গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকদের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া তো একজন প্রতিবেদক সেই প্রশ্নটি করতে চাইবেন না। কোন প্রতিবেদক যদি সেই প্রশ্নটি করেও ফেলেন, কোন নিশ্চয়তা নেই তা প্রচারিত বা প্রকাশিত হবে। কারণ প্রতিবেদক তার প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় সেই খসড়া প্রতিবেদনটি প্রধান সম্পাদক পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারে। আর যেহেতু একজন সাধারণ প্রতিবেদকের চেয়ে সম্পাদক তথা সংবাদ ব্যবস্থাপকেরই বিদ্যমান কাঠামো বা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা ও কারণ বেশি থাকে, তাই প্রতিবেদক চাইলেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পাঠক-শ্রোতা-দর্শককে জানিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র চলক নয়।
ঠিক এই জায়গায় এসেই সম্পূরক আলোচনার দ্বিতীয় বিষয়টির দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। ড. তৌফিকের লেখাটি পড়ে মনে হতে পারে মূলত প্রতিবেদক তথা রিপোর্টাররা চাইলেই দেশের সাংবাদিকতায় গুণগত পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, শুধুমাত্র সাধারণ সংবাদকর্মীরা চাইলে কোন ধরনের গুণগত পরিবর্তন আনয়নই সম্ভব নয়। অতিমারিকালে সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনায় ড. তৌফিক সাংবাদিকদের জনস্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা সম্পর্কে জানার, অর্থাৎ এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পড়ালেখা করে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশে জোর দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অতিমারির আগে হোক কিংবা পরে, আমাদের গণমাধ্যমগুলোর জন্য স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান মূলত বেশ উপেক্ষিত বিট হিসেবে রয়ে গিয়েছে, আর জনস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে ধারণা মোটামুটি অস্পষ্ট, পুরোপুরি অজানা না হলেও।
অতিমারিকালে সাংবাদিকতার সীমাবদ্ধতাগুলো উল্লেখ করতে গিয়ে ড. তৌফিক ধারণা করেছেন জনস্বাস্থ্য ও অতিমারিসংক্রান্ত নানাবিধ বিষয়ে সংবাদকর্মীদের “…সুস্পষ্ট বোঝাপড়ার অভাবের কারণে…” এরূপ ত্রুটিপূর্ণ সাংবাদিকতা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমগুলোর বর্তমান বাস্তবতায় পেশাদার সংবাদকর্মীদের, মূলত প্রতিবেদকদের জন্য নিজেদের মতো করে এসব বিষয়ে পড়ালেখা করে তথ্য সংগ্রহ ও সংবাদ প্রকাশ সম্ভব হয় না নানাবিধ কারণে। প্রথমত, স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের মতো এলাকাগুলোতে কাজ করা সংবাদকর্মীরা খুব বেশি আলোতে আসতে পারে না বিধায় এসব বিটে কেউই দীর্ঘসময় কাজ করতে চায় না। দ্বিতীয়ত, এই বিটগুলোকে মনে করা হয় হাত পাকানোর বিট। অর্থাৎ, নবিশ বা শিক্ষানবিশ প্রতিবেদকদের এসব ‘অগুরুত্বপুর্ণ’ বিটে কাজ করানোর মাধ্যমে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিটগুলোর জন্য তৈরি করা হয়। তৃতীয়ত, যে বিটেই কাজ করুক না কেন, সাংবাদিকদের জন্য নিয়মিত ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বেশির ভাগ গণমাধ্যমেই নেই। চতুর্থত, দেশের গণমাধ্যমগুলোতে অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে, এবং মূলত প্রেস রিলিজ বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখকৃত তথ্যগুলো দিয়েই ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সংবাদ প্রকাশের একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পঞ্চমত, দেশের ভেতর অসংখ্য ও নানাবিধ সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি এবং এদের নিজেদের ভেতর পাঠক-শ্রোতা-দর্শক ধরার সদা চলমান প্রতিযোগিতার কারণে একটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার মতো সময় ও অর্থ সহায়তা একজন প্রতিবেদককে দেয়া হয় না। ফলে সংবাদ প্রতিবেদনে আজকের দিনে কী ঘটেছে, সেই গতানুগতিক সংবাদের বাইরে আর কিছু পাওয়াও যায় না।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক তাঁর করা প্রতিবেদনের জন্য আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছেন। গত মে মাসে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম সংক্রান্ত বিভাগগুলোর শিক্ষকদের এক সম্মেলনে সেই সাংবাদিক উল্লেখ করেন, পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্রতিবেদনটির পেছনে তিনি ও তাঁর দল সময় দিয়েছেন প্রায় দশ মাস এবং দুইটি আলাদা প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ হাজার ডলার ও পাঁচ হাজার ইউরোর তহবিল পেয়েছেন কাজটি করার জন্য। দেশের মূলধারার কোন গণমাধ্যমের জন্য একটি সংবাদ প্রতিবেদনের পেছনে এত সংখ্যক কর্মী, সময় ও অর্থ বিনিয়োগ এক অসম্ভব কল্পনা, বাস্তবতা নিয়ে কথা না হয় তোলাই থাকলো।
দেশের গণমাধ্যমের এরূপ বাস্তবতার পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের উপরিকাঠামোর পাশাপাশি সাধারণ সংবাদকর্মীরাও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে সেই সম্ভাবনাও ফিকে হয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে জনমুখী সাংবাদিকতা করে আসা সাংবাদিকগণ নিয়মিতভিত্তিতে পেশাবদল করে অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। পেশাবদলের পেছনে আর্থিক ও পেশাগত অনিরাপত্তা, কাজের ক্ষেত্র ও স্বাধীনতা সংকোচন এবং গণমাধ্যমের সার্বিক আভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও রাজনীতির মতো কারণগুলো অন্যতম হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ফলে দেশের গণমাধ্যমগুলো দক্ষ ও প্রকৃত জনমুখী সংবাদকর্মীদের হারাচ্ছে, তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে মজুরি শ্রমের বিনিময়ে বাধ্য হয়ে গণমাধ্যমে যুক্ত হওয়া কর্মীরা, চাইলেও যাদের পক্ষে এই ব্যবস্থার বিপক্ষে দাঁড়ানো আর্থিক ও আদর্শিক, উভয় দিক থেকেই কঠিনতর।
তাছাড়া বর্তমান লেখক ও তাঁর অপর দুই সহকর্মীর একটি গবেষণা (অ্যাকাডেমিক সম্মেলনে উপস্থাপিত, শীঘ্রই প্রকাশিতব্য) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, করোনাকালে দেশে সংবাদপত্র হাউজগুলো তাদের কর্মীদের জন পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুরক্ষা সরঞ্জামাদিও সরবরাহ করতে পারে নি, প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা, শারীরিক ও মানসিক চাপ নিয়ে সংবাদকর্মীদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এর সাথে যখন দেশের গণমাধ্যমগুলোর মালিকানার প্রশ্ন যুক্ত হয়, মুনাফামুখী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থের প্রশ্ন যুক্ত হয়, আর যুক্ত হয় বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে গণমাধ্যম মালিকদের মিথোজীবীতার সম্পর্ক এবং প্রকৃত সাংবাদিকদের পেশা বদলে বাধ্য হওয়ার মত বাস্তবতা, তখন দেশের গণমাধ্যমগুলোর গুণগত পরিবর্তন আনয়ন সুদূর পরাহত ব্যতীত আর কিছু মনে হতে পারে কি?
(রচনাকাল: জুলাই, ২০২২)