শিবলী নোমান
আমাদের দেশের একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একেকটি ঘটনাবহুল স্থান। এখানে প্রতিদিন যেমন নিত্য-নতুন ঘটনা-দুর্ঘটনার উদ্ভব ঘটে, তৈরি হয় ভূতপূর্ব-অভূতপূর্ব সব সঙ্কট, তেমনি বহু পুরনো ঘটনার রেশ বা ফলাফলও প্রকাশ্য হতে দেখা যায় হরহামেশাই। তবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে নতুন ও অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের বাইরে যারা থাকেন, তাদের মুখে মুখে ফেরে আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসের কথা। এই উপন্যাসের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত আরেকটি উপন্যাস, নাম মহব্বত আলীর একদিন। আহমদ ছফার উপন্যাসটি যেমন কিংবদন্তিতুল্য হয়ে উঠেছে, ঠিক উল্টোভাবে অনেকটাই অন্ধকারে থেকে গিয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মহব্বত আলীত একদিন। অন্ধকারে না থাকলে হয়তো এই লেখাটির অবতারণার সুযোগ পাওয়া যেত না, যেখানে মূল প্রস্তাবনা হলো এই দুই উপন্যাসের উপাচার্য মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ ও মহব্বত আলী দুইজন একই ব্যক্তি, কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাসটি গাভী বিত্তান্ত-র সম্প্রসারিত রূপ। অথবা এই লেখা মূলত একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাচ্ছে, আর তা হলো, আবু জুনায়েদ ও মহব্বত আলী কি একই ব্যক্তি?
আহমদ ছফা তাঁর গাভী বিত্তান্ত রচনা করেছিলেন ১৯৯৪-৯৫ সালে। আর মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত মহব্বত আলীর একদিন প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। যেহেতু এই লেখার প্রস্তাবনা হলো, এই দুই উপন্যাসের উপাচার্য একই ব্যক্তি, কিংবা পরের উপন্যাসটি প্রথমটির এক ধরনের সম্প্রসারিত রূপ, তাই শুরুতেই এই দুই উপন্যাস বা এর চরিত্রসমূহের কিছু পার্থক্য উল্লেখ করা যেতে পারে।
গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসটিতে উপাচার্য চরিত্রটির নাম মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ। তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তা বিভিন্নভাবেই লেখক স্পষ্ট করেছেন। অন্যদিকে, মহব্বত আলীর একদিন উপন্যাসটিতে উপাচার্যের নাম মহব্বত আলী। উপন্যাসের শুরুর দিকের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় তিনি ঢাকার বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যেহেতু মহব্বত আলীর বিশ্ববিদ্যালয়টি ৭০০ একরের, মনে করা যেতে পারে এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আবার যেহেতু এই উপন্যাসে প্রক্টর ও ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা উভয় পদের উল্লেখ আছে, তাই কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্রকৌশল বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মনে হতে পারে। তবে কাহিনী এগিয়ে গেলে মহব্বত আলীর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ই বেশি মনে হয়।
অন্যদিকে, আবু জুনায়েদ যেখানে কোন ধরনের শিক্ষক রাজনীতি না করেই ২৫ বছর শিক্ষকতার পর ঘটনাচক্রে উপাচার্য হয়ে যান, তার বিপরীতে মাত্র ১০ বছরে প্রভাষক থেকে অধ্যাপক হওয়া মহব্বত আলী চাকরি হারানোর সমূহ সম্ভাবনা থেকে একেবারে উপাচার্যেরে আসনে বসে যান রাজনৈতিক পালাবদলের কল্যাণে।
আবু জুনায়েদ ও মহব্বত আলী দুইজনই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও এই দুই উপন্যাসে উপাচার্যদ্বয়ের স্ত্রীদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার ভিন্নতা দেখা যায়। আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু যেখানে ধনী ঠিকাদার পিতার কন্যা, তার বিপরীতে মহব্বত আলীর স্ত্রী কোহিনূর বেগম একজন ছা-পোষা কেরানির কন্যা।
দুই উপন্যাসের পার্থক্যের জায়গাগুলোকে একপাশে সরিয়ে এবার মিলগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। আবু জুনায়েদ বা মহব্বত আলী, দুইজনের কারো শারীরিক গড়নই আমরা সুদর্শন হিসেবে পাই না। বরং দুই ঔপন্যাসিকই উপন্যাসদ্বয়ের বিভিন্ন স্থানে এই দুইজনের কদাকার শারীরিক গড়নের কথা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আবু জুনায়েদকে ‘হনুমান’, ‘ওরাং ওটাং’ এবং মহব্বত আলীকে ‘গরিলা’ তকমা পেতে দেখা যায়। মহব্বত আলীর মুখমণ্ডল ও কদাকার শরীরের বর্ণনা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি আবু জুনায়েদের শারীরিক গড়ন সম্পর্কেও মন্তব্য পাওয়া যায়, যেমন মানুষের শরীরে বোয়াল মাছের মাথা যোগ করে দিলে যেমন দেখায়, আবু জুনায়েদ নাকি দেখতে তেমনটাই লাগে। তাছাড়া শরীরজুড়ে লম্বা লম্বা লোম থাকা এই দুই চরিত্রের আরেকটি মিল।
চরিত্রগত দিক থেকেও আবু জুনায়েদ ও মহব্বত আলীর ভেতর একটি দুর্বল মিল লক্ষ্য করা যায়। নিজ বিভাগের শিক্ষক দিলরুবা খানমের প্রতি দুর্বল হতে গিয়ে আবু জুনায়েদ উপাচার্য পদটি পেয়ে যান, অন্যদিকে মহব্বত আলীর বহুগামী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া বাসার কমবয়সী চাকর নূরজাহানকে নিয়ে তার চিন্তা/কুচিন্তা থেকে। আবার বাংলা ও ইংরেজি ভাষার উপর উপাচার্যের দক্ষতা খুব বেশি নয়, এমন অভিযোগ বা স্বগতোক্তি পাওয়া যায় দুই উপন্যাসেই।
উপরোক্ত মিলগুলো থেকে এটি স্পষ্ট হয় না যে, কীভাবে এই দুই উপন্যাসের উপাচার্যগণ একই ব্যক্তি বা একই ব্যক্তির সম্প্রসারিত রূপ। তবে মিলগুলো এই লেখার পরবর্তী অংশকে শক্তিশালী করবে, এমন আশা রেখে এগিয়ে যাওয়া যেতেই পারে।
গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসে আমরা দেখি নিরীহ ও অরাজনৈতিক শিক্ষক আবু জুনায়েদ সবেমাত্র উপাচার্য হয়েছেন। তিনি যে দল থেকে উপাচার্য হয়েছেন, পদে আসীন হওয়ার পরপরই সেই দল তাঁর প্রতি আনুগত্য একরকম প্রত্যাহার করে। উপন্যাসের শেষ দিকে আবু জুনায়েদকে নিজের আস্থাভাজনদের নিয়ে নতুন দল তৈরির কথাও ভাবতে দেখা যায়।
তাছাড়া, আহমদ ছফার উপন্যাসে উপাচার্য আবু জুনায়েদের চেয়ে তাঁর স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুই যেন প্রধান চরিত্র হয়ে ফিরে ফিরে আসেন। স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ থাকার উপলক্ষ্য ধরেই আবু জুনায়েদ উপন্যাসের শেষ দিকে প্রায় ২০ পৃষ্ঠা একান্ত নিজের দখলে নিয়ে নেন, আর এই পৃষ্ঠাগুলো থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক রাজনীতির হালচাল সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাওয়া যায়।
গাভী বিত্তান্ত যতটা না বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন উপাচার্যের কাহিনী, তার চেয়ে বেশি সম্ভবত নুরুন্নাহার বানুর মনস্তত্ত্ব ও একজন উপাচার্যের দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েনের কাহিনী। এই টানাপোড়েনের শুরু তরণী নামক এক গাভীর উপাচার্য ভবনে প্রবেশের মাধ্যমে, যার শেষটা ধরে নেয়া যায় বিষপ্রয়োগে তরণীর মৃত্যুর মাধ্যমে।
আবার, সময়ের সাথে সাথে নুরুন্নাহার বানু উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন যে উপাচার্য হওয়ার পর ধীরে ধীরে আবু জুনায়েদের উপর থেকে তার কর্তৃত্ব লোপ পাচ্ছে। আর কোহিনূর বেগমকে দেখা যায় স্বামীর প্রতি দারুণ আস্থাশীল এক স্ত্রী হিসেবে। তরণীর মৃত্যুপরবর্তী সময়ের খেলা নয় তো?
তরণীর মৃত্যুর মাধ্যমে গাভী বিত্তান্ত শেষ হলেও, তারই রেশ দিয়েই যেন শুরু হয় মহব্বত আলীর একদিন। যেখানে আবু জুনায়েদের মতো মহব্বত আলীরও গাভীপ্রীতি দেখা যায়। আবু জুনায়েদের মতো মহব্বত আলীর বাসার পেছনে খোঁজ মেলে এক গোয়ালঘরের। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই যেমন জেনে গিয়েছিলেন আবু জুনায়দের গাভীপ্রীতির কথা, তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি উপাচার্য মহব্বত আলীকে গাই গরু উপহার দিয়েছেন প্রক্টর, অর্থবিভাগের কোন একজন আর একজন ঠিকাদার। এরকমই একজন ঠিকাদারই কিন্তু আবু জুনায়েদকে উপহার দিয়েছিলেন তরণী নামের গাভীটি, বানিয়ে দিয়েছিলেন গোয়ালঘর। ঠিকাদারের কাছ থেকে গাভী উপহার নেয়ার অভ্যাসটা মহব্বত আলীরও আছে দেখা যায়!
গাভী বিত্তান্ত-তে উপাচার্য আবু জুনায়েদকে খুব কমই পাওয়া যায়, যতটুকু না হলেই না। বরং প্রদীপের প্রায় সবটুকু আলোই পড়েছিল তাঁর পারিবারিক জীবনের উপর। এক কথায়, এই উপন্যাসটি উপাচার্য ভবনের বাইরে খুব একটা যায় নি। তাছাড়া আবু জুনায়েদ উপাচার্যের দায়িত্ব নেয়ার পর খুব বেশি সময় ধরে উপন্যাসটি বিস্তৃত, তাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ গর্ভবতী তরণী উপাচার্য ভবনে আসার ছয় মাসের ভেতর উপন্যাসটি শেষ হতে দেখা যায়।
কিন্তু মহব্বত আলীর একদিন-এ আমরা একজন উপাচার্য মহব্বত আলীকে একজন পুরোদস্তুর উপাচার্য হিসেবে পেয়ে যাই, যেখানে তাঁর পারিবারিক জীবনের উপস্থিতি যৎসামান্য, যেটুকু না হলেই নয়। আবু জুনায়েদের যে উপাচার্য সত্তাটি গাভী বিত্তান্ত-তে অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল, সেই সত্তাটি নিয়েই যেন হাজির হন মহব্বত আলী। যেখানে উপাচার্য ভবন নয়, উপাচার্যের দপ্তরই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু। আর এই উপন্যাসেই উঠে আসে উপাচার্য পদে টিকে থাকার জন্য কীভাবে মহব্বত আলী তাঁর দল ভারী করেছেন শাম-দাম-দণ্ড-ভেদ, সবকিছু ব্যবহার করে। আরো উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজে অর্থের লেনদেন, শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা, ভোটের রাজনীতি, তোষামোদ, সন্ত্রাসী ছাত্র-শিক্ষক লালন-পালন ও সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি নিপীড়নের মতো বিষয়ে নাতিদীর্ঘ কিন্তু তীক্ষ্ণ বয়ান। এছাড়া, গাভী বিত্তান্ত-তে উপস্থিত সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতাকে অনেক বেশি শক্তিশালীরূপে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় মহব্বত আলীর একদিন-এ, সময় ও বাস্তবতার আলোকেই হয়তো।
গাভী বিত্তান্ত-র শেষ দিকে আমরা যেমন আবু জুনায়েদের মস্তিষ্কে নিজ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ভাবনা ও সে অনুযায়ী ছক কষতে দেখি, মহব্বত আলীর একদিন-এ যেন সেই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতার এমনই এক শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি মহব্বত আলীকে। আর এই শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থেকেই মহব্বত আলী উপাচার্য হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান পুরো এক মেয়াদ, চার বছর, অথবা ১,৪৬১ দিন। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করেন – ছফা যাকে বলেছিলেন – ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত বিশ্ববিদ্যালয়-এ।