শিবলী নোমান

পরিবর্তনশীল বিশ্বাস ও অপরিবর্তিত আশাবাদের ৮০ বছর

ভাষান্তর: শিবলী নোমান

(এনবিসি টেলিভিশনের জন্য ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক বার্ট্রান্ড রাসেলের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন এনবিসি-র লন্ডন ব্যুরোর সংবাদ বিভাগের তৎকালীন প্রধান রমনি হুইলার। ১৯৫২ সালের ১৮ মে বার্ট্রান্ড রাসেলের ৮০তম জন্মদিনে এই সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারটির অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইংরেজি ট্রান্সক্রিপ্টের জন্য সহায়তা নেয়া হয়েছে এই লিংক থেকে। আর পুরো সাক্ষাৎকারটি দেখা যেতে পারে এখান থেকে।)

বার্ট্রান্ড রাসেল: শুভেচ্ছা (রমনি)!

রমনি হুইলার: আপনাকেও শুভেচ্ছা, লর্ড রাসেল!

রাসেল: আপনি কি বসবেন না? আর আমরা কী নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি?

রমনি: দেখুন লর্ড রাসেল, যেহেতু সামনেই আপনার ৮০তম জন্মদিন, তাই আমি মনে করি আমরা চাই আপনি আমাদের বলুন যে, আপনার মতে একজন দার্শনিক হিসেবে আপনি কোন বিষয়গুলো জানতে ও বুঝতে পেরেছেন এবং কোন বিষয়গুলো আপনি কখনোই জানতে বা বুঝতে পারবেন না বলে মনে করেন?

রাসেল: আসলে আমি মনে করি এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমার কখনোই জানা বা বুঝা উচিত হবে না এবং এজন্যই আমি কখনোই এগুলো জানতে বা বুঝতে চাই না। পৃথিবী সম্পর্কে আমার আশাবাদ পরিবর্তনের জন্য আমি কিছু জানতে বা বুঝতে চাই না। পৃথিবীর অবস্থা, সামনে কী হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে আমার বিশ্বাস পরিবর্তনের জন্য আমি প্রস্তুত আছি, কিন্তু আমার আশা পরিবর্তনের জন্য আমি প্রস্তুত নই। এ ব্যাপারে আমি অপরিবর্তনীয় অবস্থায় থাকতে চাই। তাই আমি মনে করি আমাদের কথা বলার বিষয়কে আমরা “পরিবর্তনশীল বিশ্বাস ও অপরিবর্তিত আশাবাদের ৮০ বছর” নাম দিতে পারি। ১৯১৪ সাল কিংবা তার পরে জন্মগ্রহণ করা যে কারো জন্য এটি উপলব্ধি করা খুব কঠিন হবে যে, আমি যখন শিশু ছিলাম সেই সময়ের বিশ্বের চেয়ে বর্তমান বিশ্ব কতটা গভীরভাবে পার্থক্যপূর্ণ। এই পরিবর্তনগুলো প্রায় অবিশ্বাস্য। এই সময়ের বছরগুলো নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি এমন একটি বিশ্বে বসবাসের জন্য নিজেকে মানিয়ে নিতে; যে বিশ্ব পারমাণবিক বোমার, যেখানে প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলো ভোরের কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায়, এমন এক বিশ্ব যেখানে আমাদের এশীয়দের জবরদস্তিমূলক আত্মপ্রচার ও সাম্যবাদের হুমকির ভেতর বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হতে হয়। আসলে যখন আমার বয়স অল্প ছিল তখন সবকিছু অনেক বেশি অন্যরকম ছিল, আর তাই এখনকার মতো একটি পৃথিবীতে একজন বৃদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকা খুবই কঠিন এক বিষয়। আমার জন্ম ১৮৭২ সালে। শৈশবেই আমার বাবা-মা মারা যান আর তাই আমি আমার দাদা-দাদির কাছে বড় হই।

রমনি: আপনি কি আমাদেরকে আপনার দাদার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?

রাসেল: হ্যা, আমি আপনাকে আমার দাদা সম্পর্কে কিছু বলতেই পারি। তিনি জন্মেছিলেন (১৭৯২ সালে) ফরাসি বিপ্লবের প্রথমদিকের একটি বছরে। (১৮১৩ সালে) যখন তিনি পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন, নেপোলিয়ন তখনো ক্ষমতায়। (চার্লস জেমস) ফক্সের অন্য সকল হুইগ অনুসারীদের মতো তিনিও মনে করতেন যে, নেপোলিয়নের প্রতি ইংরেজ বৈরিতা ছিল মাত্রাতিরিক্ত, এবং তিনি এলবায় নেপোলিয়নের সাথে দেখা করেছিলেন। তিনিই ১৮৩২ সালে রিফর্ম বিল উত্থাপন করেন, যার ফলে ইংল্যান্ড গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। মেক্সিকান যুদ্ধ (১৮৪৬-১৮৪৮) ও ১৮৪৮ সালের বিপ্লব চলাকালীন সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আমি তাকে বেশ ভালোভাবেই স্মরণ করতে পারি; কিন্তু দেখুন, তিনি এমন একটি যুগের মানুষ যে যুগকে এখন কিছুটা মুছেই ফেলা হয়েছে বলে মনে হয়। আর আমার শৈশবের দুনিয়া ছিল একটি সারবান দুনিয়া, যেখানে সেই সব বিষয় ছিল, যা চিরস্থায়ী হবে বলে মনে করা হতো; আর সে সবই এখন হারিয়ে গিয়েছে। মানুষ কখনো এটি ভাবে নি যে এগুলো কখনো থেমে যেতে পারে। ইংল্যান্ডের মানুষ ইংরেজদের নৌ-আধিপত্যকে প্রাকৃতিক আইনের মতোই মনে করতো। “সমুদ্রের ঢেউকে ব্রিটেন শাসন করে”! আমাদের কখনো মনে হয় নি যে তা শেষ হয়ে যেতে পারে।

রমনি: বিসমার্কের ব্যাপারেও কি তাই?

রাসেল: বিসমার্ককে একজন দুর্বৃত্ত মনে করা হতো, আর আমরা তাকে একজন অশিক্ষিত কৃষক হিসেবেই ভেবেছিলাম। তবে এটি ধারণা করা হয়েছিল যে গ্যাটে ও (ফ্রেডরিক) শিলারের প্রভাব জার্মানিকে ধীরে ধীরে একটি অধিক সভ্য দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে আসবে। তাছাড়া আমরা জার্মানিকে একটি নিছক ভূ-শক্তি হিসেবে ভেবেছিলাম। সেই সময় জার্মানির কোন নৌ-বাহিনী ছিল না। তার উপর, আমরা জার্মানিকে নিয়ে কোন অর্থেই ভীত ছিলাম না। আসলে সেই সময়ের উদার মতামতগুলো ফ্রান্সের চেয়ে জার্মানির প্রতিই ছিল বেশি পক্ষপাতপূর্ণ। জার্মানি ও ইংল্যান্ডকে বিসমার্ক নিজে তুলনা করেছিলেন একটি হাতি ও একটি তিমি মাছের সাথে। নিজেদের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রত্যেকেই দুর্দান্ত, কিন্তু একে অপরের জন্য বিপজ্জনক নয়। আর আমরা এমনটাই মনে করতাম। তাই বিসমার্ককে নিয়ে আমাদের কোন ধরনের ভয়ই ছিল না। এমনটা ভাবা হতো যে, বিশ্বব্যাপী কাঠামোবদ্ধ প্রগতি হতে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সকল দেশকেই সংসদীয় ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। থাকবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা আর দুইটি (রাজনৈতিক) দল; আর পৃথিবীর সব জায়গাতেই এটি হবে একেবারে ইংল্যান্ডের মতো করে। আমার দাদি হাসতেন কারণ একবার তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন, “কোন এক সময় হয়তো আপনারাও রাশিয়াতে সংসদ পাবেন”। আর রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, “ঈশ্বর যেন তা না করেন, প্রিয় লেডি রাসেল”। আজকের রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হয়তো একই উত্তর দিবেন, শুধু বাদ যাবে ঈশ্বরের অংশটুকু। তবে ধারণা এটিই ছিল যে সবকিছুই বেশ সুন্দরভাবে নির্দিষ্ট ধারা মেনে হবে। রাজনীতির বাইরের আবহাওয়া ছিল পিউরিটান ধর্মানুরাগী; অনেক বেশি ধর্মানুরাগী ও অনেক বেশি কঠোরতাপূর্ণ। সকাল আটটায় আমরা নিয়মিত প্রার্থনা করতাম, আর এই পারিবারিক প্রার্থনার আগে আমাকে আধা ঘণ্টা পিয়ানো বাজাতে হতো, যা আমি ঘৃণা করতাম। যদিও বাড়িতে আটজন চাকর ছিল, খাবারগুলো সর্বদাই থাকতো সর্বাপেক্ষা সাধারণ ধরনের। আর তার চেয়েও বড় বিষয় ছিল এই যে, যদি সেখানে খুব ভালো কোন খাবার থাকতোও, সেটি খাওয়ার অনুমতি আমার থাকতো না; কারণ ভালো ভালো জিনিস খাওয়া বাচ্চাদের জন্য ভালো নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, কখনো কখনো থাকতো রাইস পুডিং ও অ্যাপেল টার্ট। নিয়ম ভাঙা যাবে না আর তাই আমি পেতাম রাইস পুডিং। এভাবে সব ক্ষেত্রেই ছিল অত্যন্ত কঠোরতা। আরও বলতে হয়, ৭০ বছরের বেশি বয়স না হলে মায়েরা কখনো রাতের খাবার শেষ হওয়ার আগে আরাম করতে আর্মচেয়ারে বসতেন না, কখনোই না। এ ধরনের কঠোরতার ভেতর দিয়েই স্বচ্ছল মানুষেরা জীবন-যাপন করতো, সেই দিনগুলোতে এটি ছিল বেশ সাধারণ।

রমনি: আপনি কখন ক্যামব্রিজে গেলেন?

রাসেল: আমি গিয়েছিলাম যখন আমার বয়স ছিল ১৮, আর অবশ্যই সেটি ছিল আমার জন্য এক নতুন দুনিয়া। প্রথমবারের মতো আমি এমন মানুষদের সাথে পরিচিত হলাম যারা আমার চিন্তাপ্রসূত বক্তব্যগুলোকে কখনোই অবান্তর মনে করতো না। আমার বাড়িতে আমাকে আমার ভাবনাগুলো নিয়ে প্রায় কিছুই না বলতে শেখানো হয়েছিল। আমি দর্শনের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম, (যদিও) আমার আশেপাশের মানুষের ভেতর ছিল দর্শনভীতি। এবং দর্শনের ব্যাপারে কথা উঠলে প্রতিবারই তারা বলতো, “দুইটি প্রশ্নের ভেতরই দর্শনের পুরো বিষয় প্রোথিত। কোনটি ভালো? এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। ভাবনা কী? কিছুই না”। আর সম্ভবত এই কথাগুলোর ষাটতম বারের পুনরাবৃত্তির সময় আমি আর এটি থেকে মজা পাচ্ছিলাম না। যখন আমি ক্যমাব্রিজে গেলাম, আমার জন্য এটি ছিল খুবই আরামদায়ক ব্যপার যে আমি এমন সব মানুষ খুঁজে পেলাম যারা দর্শনকে অবান্তর বা বিমূর্ত মনে করে না। আর এজন্য যখন আমি প্রথমবার ক্যামব্রিজে যাই, আমি ছিলাম অনেক বেশি খুশি, খুবই খুশি। খুব দ্রুতই আমি দারুণ কিছু মানুষের সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম যারা আজীবনের জন্য আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। এটি দুঃখজনক যে, তাদের অধিকাংশই এখন মৃত, তবে যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্বও রয়েছে অটুট।

রমনি: আপনি তো গণিতশাস্ত্র নিয়ে শুরু করেছিলেন, তাই নয় কি? আর এর পর দর্শন?

রাসেল: ঠিক তাই। ক্যামব্রিজে আমি তিন বছর গণিতশাস্ত্র আর এক বছর দর্শন নিয়ে পড়ালেখা করেছিলাম। ক্যামব্রিজে যাওয়ার আগে আমি শুধুমাত্র গণিতই পড়েছিলাম।

রমনি: দর্শনের প্রতি আপনার আগ্রহের কারণ কী?

রাসেল: আসলে ভিন্নধর্মী দুইটি বিষয় দর্শনের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ। প্রথমত, আমি গণিতশাস্ত্রের মূলসূত্রগুলো বুঝতে চাচ্ছিলাম। আমি দেখেছিলাম যে, গাণিতিক বিবৃতিগুলোর প্রমাণ হিসেবে আমাকে যা শেখানো হচ্ছিলো তার সবই ছিল বিভ্রান্তিকর। যা প্রমাণের কথা তারা বলছিল, আসলে তারা সেটি প্রমাণ করছিল না। আর আমি জানতে চাচ্ছিলাম যে পৃথবীতে আদৌ এমন কোন সত্য আছে কিনা যা (মানুষের) জানা আছে। আর আমি ভেবেছলাম যদি এমন কিছু থেকে থাকে, এটি গণিতশাস্ত্রের ভেতরই রয়েছে। কিন্তু আমাকে যেভাবে গণিত শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, তার ভেতরে এটি ছিল না; আর এজন্যই আমি সেখানে কিছু সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। অপর যে বিষয়টি আমাকে দর্শনের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল, তা হলো এই আশাবাদ যে, আমি হয়তো এর ভেতর ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন ভিত্তি খুঁজে পেতে পারি।

রমনি: আর আপনি কি তা পেয়েছিলেন?

রাসেল: না, গাণিতিক অংশ নিয়ে আমার আশাবাদের ব্যাপারে আমি অনেকটাই সন্তুষ্ট ছিলাম, কিন্তু অপর অংশে তেমনটা হয় নি, একেবারেই হয় নি। কিছু সময়ের জন্য চিন্তাময় আদি-বিশ্ববিষয়ক প্লেটোনিক ভাবনার ভেতর আমি কিছুটা সন্তুষ্টি পেয়েছিলাম, এতে ছিল এক ধরনের ধর্মীয় স্বাদ এবং এটি আমাকে কিছুটা সন্তুষ্টি দিয়েছিল। কিন্তু পরে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে এটি ছিল আসলে অর্থহীন। আর এ বিষয়ে আমার আকাঙ্ক্ষাগুলো ছাড়া অন্য কোন ধরনের সন্তুষ্টি ছাড়াই আমি থেকে গেলাম। তাই বলা যায়, এক্ষেত্রে দর্শন আমার কাছে বিবর্ণ হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল; কিন্তু গণিতশাস্ত্রের প্রায়োগিক ভিত্তির ক্ষেত্রে এমনটা হয় নি।

রমনি: এটিই কি সেই পর্যায়ে প্রবেশ নয়, যেটিকে আপনি বলেন একটি বৈসাদৃশ্যের জীবন?

রাসেল: হ্যা, গণিতশাস্ত্র ও দর্শন উভয় বিষয়েই আমি প্রথমে আমার কাছের মানুষদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলাম। তারা শুধুমাত্র সদগুণকেই পাত্তা দিতো। তারা ভাবতো সদগুণই হলো পৃথিবীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই গণিতশাস্ত্র ছিল অগুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এতে কোন নৈতিক আধেয় ছিল না। আর দর্শন ক্ষতিকর ছিল কারণ এটি সদগুণের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতো। আর এজন্য সেই সময়ে আমার কাছের মানুষদের সাথে আমার ছিল শক্তিশালী মতনৈক্য। তবে এই বৈসাদৃশ্য বা মতনৈক্যর সাথে আমার ব্যক্তিগত জীবন যতটা যুক্ত ছিল, নিশ্চিতভাবেই তার সুরাহা হয়ে গিয়েছিল এমন সব বিদ্বান মানুষদের সাথে আমার বসবাস করার কারণে, যারা ঐভাবে ভাবতো না। ফলে আবারও আমি এমন মানুষদের একটি চক্রে জায়গা পেয়েছিলাম, যাদের সাথে আমি অনেকটা পরিবারের মতোই ছিলাম। কিন্তু সেটি শেষ হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দ্বারা, যেখানে আমি একটি শান্তিবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম। আমি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলাম। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলাম না। অনেকেই মনে করে এটি এক ধরনের অধারাবাহিকতা, কিন্তু এটি তা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমি কখনো বলি নি যে, আমি সকল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমি বলেছিলাম আমি ঐ যুদ্ধটির বিরোধিতা করছি, আর আমি এখনো সেই মতই ধারণ করি। আমি মনে করি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল একটি ভুল, আর ঐ যুদ্ধে ইংল্যান্ডের অংশ নেয়াও ছিল একটি ভুল। আমি মনে করি, যদি এটি না হতো তাহলে আপনি কমিউনিস্টদের পেতেন না, নাৎসিদের পেতেন না, পেতেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আপনার জন্য থাকতো না তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধের হুমকি। আমি মনে করি পৃথিবীটা হতে পারতো আরো অনেক বেশি ভালো একটি জায়গা। কাইজারের সময়ের জার্মানি অসভ্য ছিল না। সেখানে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দমনপীড়ণ ছিল, কিন্তু বর্তমানে ইংল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া ছাড়া আর সব জায়গার দমনপীড়ণের চেয়ে সেটি ছিল পরিমাণে কম। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে এটি আসলে খুব খারাপ ছিল না। প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্যে কাইজারের সরকারকে ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু এটি ছিল শুধুই আলোচনা, এতে সত্যতা ছিল না।

রমনি: বর্তমান সময়ে রাশিয়া সম্পর্কে আপনার মতামত সব মিলিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। আপনি কি বলশেভিকদের সম্পর্কে সবসময়ই এমনটা ভাবতেন?

রাসেল: হ্যা, আর সেটি হয়েছিল আরেকটি প্রবল বৈসাদৃশ্যের কারণ।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি শান্তিবাদী ছিলাম, আর এই শান্তিবাদিতা চলাকালে আমি সেসব মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম, যাদেরকে হয়তো আপনি বলবেন গতানুগতিক মানুষ। আর তখন, ১৯২০ সালে আমি রাশিয়ায় গিয়েছিলাম এবং সোভিয়েত সরকারকে প্রচন্ডভাবে অপছন্দ করেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম তারা ভয়ঙ্কর মানুষ, যারা দিনে দিনে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, নিশ্চিতভাবেই আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। আর এজন্যই আমি তখন সেই সব মানুষের থেকে আলাদা হয়ে যাই যারা আমার শান্তিবাদিতাকে এতদিন সহ্য করে এসেছিল, যাদের সবাই রাশিয়াকে পছন্দ করতো অথবা ভাবতো যে তারা তা করে। আর তাই সেই সময়ে আমি অত্যন্ত একা হয়ে যাই। যদিও চীনে গিয়ে আমি একাকীত্বের বেদনা থেকে কিছুটা নিস্তার পেয়েছিলাম। (সেখানে) আমি দারুণ একটি বছর কাটিয়েছিলাম। চীনাদের আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল। আর সেখানে আমি এমন সব মানুষ পেয়েছিলাম যাদের সাথে আমি একমত হতে পারি, যাদের আমি পছন্দ করতে পারি।

রমনি: চীনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিতে চান?

রাসেল: দেখুন, আমি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানি না। আমি মনে করি না আমি কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসেছিলাম। আমি আগে যেমনটা ভাবতাম সেরকম ভাবাই জারি রেখেছিলাম। আর তা হলো গণতন্ত্র যেখানে ঠিকমতো কাজ করে সেখানে গণতন্ত্রই হলো সর্বাপেক্ষা ভালো সরকার পদ্ধতি। এটি চীনে খুব ভালোভাবে কাজ করছিল না, একেবারেই কাজ করছিল না। আর যে কেউই দেখতে পাচ্ছিলো যে এটি সেখানে কাজ করবে না। তাদের সে ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে আমি ভেবেছিলাম যে সময়ের সাথে সাথে গণতন্ত্র সেখানে কাজ করবে; আর আমি বলতে চাই যে, যদি চীনে পরিস্থিতি আরেকটু বেশি অনুকূল থাকতো, তাহলে গণতন্ত্র সেখানে সফল হতে পারতো।

রমনি: আপনি ফিরে আসার পর আপনার মনোযোগের বিষয় পরিবর্তিত হয়েছিল, তাই নয় কি?

রাসেল: হ্যা। আমার প্রথম দুই সন্তানের জন্মের সাথে সাথে আমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠি। প্রথমে বিশেষভাবে আগ্রহী হই খুবই অল্প বয়সীদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি। বেশ কিছু কারণে আমি পুরনো ধারার বিদ্যালয়গুলোকে পছন্দ করতাম না। আমি প্রগতিশীল বিদ্যালয়গুলোকেও নিরঙ্কুশভাবে পছন্দ করি নি। আমি মনে করেছিলাম কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রগতিশীল বিদ্যালয়গুলো পুরনোগুলোর তুলনায় বেশ ভালো। তবে প্রগতিশীল বিদ্যালয়গুলোর তথা এমন অধিকাংশ বিদ্যালয়ের কিছু বিষয়কে আমি সঠিক মনে করতাম না। আমার মনে হয় তারা নির্দেশনা প্রদানের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতো না। আমি মনে করি আপনার যদি বিবেচনাযোগ্য পরিমাণের প্রকৃত জ্ঞান না থাকে, তাহলে একটি জটিল কৌশলগত পৃথিবীতে আপনি কোন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। আর আমি এও মনে করি যে, বিদ্যালয়গুলোতে যদি নির্দিষ্ট পরিমাণে শৃঙ্খলা না থাকে তাহলে বেশির ভাগ শিশুই খুব বেশি জ্ঞান আহরণ করতে পারবে না। আমার মনে হয় জ্ঞানার্জনের জন্য যে প্রকৃত শৃঙ্খলার প্রয়োজন হয় তা উপর থেকে চাপিয়ে দিতে হয় এবং আমার পরিচিত অনেক আধুনিক বিদ্যালয়েই এটি যথাযথভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না।

রমনি: এ বিষয়ে আপনি কি আপনার কোন মতামত পরিবর্তন করেছেন?

রাসেল: আমি মনে করি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমি নিজে একটি বিদ্যালয় চালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কারণ অন্যান্য বিদ্যালয় নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। একজন প্রশাসক হওয়ার গুণাবলি আমার ভেতর ছিল না; আর যে বিদ্যালয়টি আমি চালানোর চেষ্টা করেছিলাম, তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। দৈবক্রমে সেই সময়েই আমি (তাদের ব্যাপারে) আগ্রহী ছিলাম এমন কিছু আধুনিক বিদ্যালয় যথেষ্ট ভালো করছিল বলে আমার মনে হয়েছিল, আর আমি তা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। আমি মনে করি শুধুমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই নয়, বরং অনেকগুলো বিষয়ে আমি আমার মতামত পরিবর্তন করেছি। মানুষের বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম দেখার ফলে আমার মনে হয় যে স্বাধীনতা সকল রোগের ওষুধ নয়। আমার মনে হয়ে এমন অনেক বিষয়ই আছে যেখানে স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। বর্তমানে এমনই কিছু বিষয়ে সেই যথাযথ নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি মনে করি, বিভিন্ন দেশের ভেতর সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখনকার চেয়ে কম স্বাধীনতা থাকতে হবে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বিষয়টি কিছুটা প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। কিছু কিছু প্রগতিশীল বিদ্যালয়ে আপনি যতটুকু পেতে চান তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা রয়েছে। আমি মনে করি কিছু কিছু স্বাধীনতা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আকাঙ্ক্ষিত হবে। যেমন, পুরনো ধারার বিদ্যালয়গুলোতে একটি শিশু যদি একটি খারাপ বা আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার করে তাহলে এটিকে তার করা একটি নিষ্ঠুর কাজের চেয়ে বেশি খারাপ মনে করা হয়; বিষয়টি একেবারেই উদ্ভট। স্পষ্টতই নিষ্ঠুর কাজটির প্রভাব বেশি, আর এমন সব কারণেই আমি পুরনো ধাঁচের বিষয়গুলো পছন্দ করি না। আমি এটিও মনে করি যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত শিশুদেরকে জীবনের বাস্তবতাগুলো অনুসন্ধানের স্বাধীনতা দেয়া উচিত, পুরনো ধারায় যা তাদের দেয়া হয় না। আমি মনে করি বাক-স্বাধীনতা থাকা উচিত। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অনেকগুলো বিষয়কে আমি খুবই পছন্দ করি। তবে আমি মনে করি শিক্ষাব্যবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়গুলোতেও স্বাধীনতার অবশ্যই অত্যন্ত নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। যেখানে আপনি এমন সব কাজ করেন যা অপরাপর মানুষের জন্য ক্ষতিকর, অথবা এমন সব কাজ যা আপনাকে মূল্যবান হিসবে গড়ে উঠতে বাধা দেয়, যেমন জ্ঞানের অভাব। আর তাই এমন সব বিষয় আছে যার কারণে আমি মনে করি যে, আগেকার সময়ের তুলনায় স্বাধীনতার উপর আমার কম গুরুত্ব প্রয়োগ করা উচিত।

রমনি: আপনি কি এখনো বিমূর্ত দর্শনের গুরুত্বে বিশ্বাস করেন?

রাসেল: এটি খুবই কঠিন একটি প্রশ্ন। স্পষ্টতা, নির্ভুলতা ও নিখুঁত রূপরেখার প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ আছে। এটি মানুষকে মনে করায় যে আমার কোন কিছুর প্রতিই অনুরাগ নেই, যেন আমি এক শীতল মানুষ; যদিও আমি এর কারণটি কখনোই বুঝতে পারি নি। আমি জানি না কেন, কিন্তু বিষয়টি মানুষকে এভাবেই ভাবায়। আমি মনে করি না সব মিলে এটি সঠিক কিছু। আর তাই এর কোন নির্দিষ্ট উত্তর নেই। তবে আমি স্পষ্টতা ও নির্ভুল চিন্তা পছন্দ করি এবং আমি বিশ্বাস করি এটি মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যখন আপনি নিজেকে অ-নির্ভুলভাবে ভাবার সুযোগ দিচ্ছেন তখন আপনার সংস্কার, পক্ষপাতিত্ব, আত্মস্বার্থগুলো আপনার অজান্তেই আপনার সামনে চলে আসে; আর এর ফলে আপনি খারাপ কাজ করছেন তা না জেনেই কাজটি করে ফেলেন। আত্মপ্রতারণা খুবই সহজ একটি বিষয়। আর তাই আমি মনে করি স্পষ্ট চিন্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি এটি মনে করি না যে পুরনো দিনের দর্শন সেই জিনিস, যা পৃথিবীর বর্তমানে প্রয়োজন। আগের সেই অবস্থান থেকে পৃথিবীর চাহিদা এখন আলাদা।

রমনি: তাহলে আজকের দিনের চাহিদাগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?

রাসেল: দেখুন, নিশ্চিতভাবেই চাহিদা নির্ভর করে একজন ব্যক্তির সক্ষমতাগুলোর উপর। কিন্তু আমি যদি বর্তমান সময়ে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার একজন তরুণ হতাম, তাহলে আমি দর্শন নিয়ে এগুতাম না। আমি মনে করি আরো অনেক ভালো ভালো জিনিস আছে। প্রয়োজনীয় সক্ষমতা থাকলে সম্ভবত আমি একজন পদার্থবিদ হতাম। যদি সেদিকে যাওয়ার মতো সক্ষমতা আমার না থাকতো, তাহলে আমার ভাবা উচিত হতো ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান—মূলত গণমনোবিজ্ঞান, রাজনৈতিক তত্ত্বাবলী—খাঁটি দর্শনের চেয়ে এহেন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা বেশি মূল্যবান। আর এগুলোই হলো সেই সব বিষয়, যা নিয়ে আমি কাজ করতাম যদি এখন আমি বয়সে তরুণ হতাম।

রমনি: লর্ড রাসেল, আরো সুখী একটি অবস্থায় যাওয়ার জন্য পৃথিবীর কোন বিষয়গুলো প্রয়োজন বলে আপনার মনে হয়?

রাসেল: আমি মনে করি পৃথিবী যদি নিজেকে শিল্প বিপ্লবের সাথে মানিয়ে নিতে চায় তাহলে তিনটি বিষয় রয়েছে, যেগুলোর প্রয়োজন হবে। এখন আমরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি সেগুলো হলো মানবজীবনের একটি নতুন পর্যায়ের সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে উদ্ভূত সমস্যাবলী, এই পর্যায়টিকে বলা হয় শিল্প পর্যায়। আর আমি মনে করি, এই শিল্প (বিপ্লব পরবর্তী শিল্পনির্ভর) পর্যায়ে সুখীভাবে থাকতে হলে মানুষের তিনটি বিষয়ের প্রয়োজন রয়েছে। এর একটি হলো বৈশ্বিক সরকার; দ্বিতীয়টি হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের ভেতর অর্থনৈতিক প্রায়-সমতা; আর তৃতীয় হলো একটি প্রায়-স্থির জনসংখ্যা। আমি এর প্রতিটি সম্পর্কে অল্প করে বলতে চাই। বৈশ্বিক সরকারের ক্ষেত্রে বলতে হয়, এটিকে অবশ্যই হতে হবে একটি ফেডারেল সরকার যেখানে স্বতন্ত্র জাতীয় সরকারগুলোর স্বাধীনতার মাত্রা থাকবে অনেক বেশি। শুধুমাত্র যুদ্ধ এড়াতে অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই বৈশ্বিক সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। এর ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাপেক্ষা কঠিন বিষয় হলো সশস্ত্র বাহিনীগুলো। যুদ্ধের সকল প্রয়োজনীয় অস্ত্রাদি একমাত্র আন্তর্জাতিক সরকারের হাতেই ন্যস্ত থাকবে। যখন এমনটা হবে তখন বাস্তবিক পক্ষে যুদ্ধ হয়ে পড়বে অসম্ভব, আর যুদ্ধ অসম্ভব হলেই মানবজাতি সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। যদি যুদ্ধ অসম্ভব হয়ে না উঠে, তাহলে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রতিটি অগ্রগতির মানেই হলো গণহত্যার দিকে আরেকটু করে এগিয়ে যাওয়া, আর তাই তা হলো অপ্রত্যাশিত। কিন্তু বৈশ্বিক শান্তি অর্জিত হলে ঠিক এর বিপরীতটি ঘটবে। এটি ছিল প্রথম বিষয়। এখন আমি কথা বলতে চাই অর্থনৈতিক প্রায়-সমতার প্রশ্নে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বলা যায়, পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সার্বিকভাবে জীবনমান বেশ উচ্চ—যুক্তরাষ্ট্রে এটি পশ্চিম ইউরোপের চেয়েও বেশি। বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসব অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ বেশ আরামদায়ক জীবন যাপন করে। অন্যদিকে এশিয়ায় মানুষের জীবন কাটে অনেক অনেক বেশি দারিদ্র্যের ভেতর, আফ্রিকার অধিকাংশ স্থানের জন্যও এটি সত্য। আর যখনই মানুষ এসব বাস্তবতা বুঝার জন্য যথেষ্ট শিক্ষিত হয়ে উঠে, এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হয় বিশ্বের দরিদ্রতর অংশগুলোর ভেতর গভীর বিদ্বেষের উদ্ভব। এই বিদ্বেষ আস্থিরতার একটি কারণ এবং নিশ্চিতভাবেই এটি বিশ্বশান্তিকে অনিশ্চিত করে তোলে। এই অবস্থাকে মোকাবিলা করার উপায় মাত্র একটি, আর তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায়-সমতা তৈরি করা। এটি বেশ দীর্ঘসূত্রী, কিন্তু করা সম্ভব। জনসংখ্যা বিষয়ক তৃতীয় অবস্থানটি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাটির উপরিস্তরের ক্ষয়সাধনের ফলে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের নিম্নগামিতা দেখা যাচ্ছে। একই সাথে নানা ধরনের প্রাযুক্তিক অগ্রগতির ফলে উৎপাদনকে নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তবে এই দুইটি বিষয়ের ভেতর ভারসাম্য নেই। তাই সার্বিকভাবে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে নি। মূলত এর মানে হলো, যদি আপনার অর্থনৈতিক সমতা থাকে আর আপনি যদি না চান যে প্রত্যেকে হবে খুবই দরিদ্র, তাহলে সেখানে খাদ্য গ্রহণের জন্য খুব বেশি মানুষ থাকা কোনভাবেই চলবে না, এখন যে পরিমাণ মানুষ আছে তার চেয়ে খুব বেশি থাকা চলবে না। আর এজন্যই আপনার থাকতে হবে জনসংখ্যার যথাযথ সামঞ্জস্য এবং প্রায়-স্থির জনসংখ্যা। তা নাহলে, পৃথিবীর যেসব অংশে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় সেই জায়গার মানুষ যুদ্ধে যেতে চাইবে সেই অংশের বিরুদ্ধে, যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম।

রমনি: বিষয়টি আমাদেরকে এশিয়ার সমস্যার দিকে নিয়ে এসেছে, অদূর ভবিষ্যতে এশিয়া কী ভূমিকা রাখবে?

রাসেল: প্রথমত, শিক্ষার প্রশ্নে এশিয়া, কিংবা কিছু কিছু এশিয়ান জেগে উঠেছে, যেখানে তারা আর সাদা মানুষদের অধীনে থাকতে প্রস্তুত নয়। তারা এটি খেয়াল করে নি যে রাশিয়ানরাও সাদা। যদি তারা এটি খেয়াল করতো, তাহলে তারা ভিন্ন রাস্তা নিতো। কিন্তু তারা ভাবে রাশিয়ানদের গায়ের রঙ হলুদ বা কালো বা অন্য কিছু। আর আমি মনে করি যে আমাদের প্রোপাগান্ডা প্রধানত হতে হবে শুধু এই বলা যে, রাশিয়ানরাও সাদা। আমি বিশ্বাস করি এটি হবে এশিয়ায় ব্যবহারের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী প্রোপাগান্ডা। কিন্তু আমি সে আলোচনায় যাবো না। স্পষ্টতই সাদা মানুষদের সাথে এশিয়া সমতা দাবি করতে যাচ্ছে। আর সাদা মানুষদের জন্য এই খেলাকে প্রতিরোধ করতে যাওয়া হবে পুরোপুরি নিষ্ফল একটি বিষয়। এশিয়ানরা নিশ্চিতভাবেই জিতবে, নিশ্চিতভাবে। আর তাই যদি আমরা না চাই এই বিষয়টি মেনে নিতে আমাদেরকে বাধ্য করা হোক, তাহলে এশিয়ার সাথে শতভাগ সমতা আমাদেরকে বিনয়ের সাথে মেনে নিতে হবে। কিন্তু এশিয়া যদি পৃথিবীর বাকি অংশকে জনসংখ্যা ও দারিদ্রতার স্রোতে চাপা দিতে না চায়, তাহলে এশিয়াকে তার দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। আর পশ্চিমে আমরা যেসব বিষয় শিখেছি, তাদেরকেও তা শিখতে হবে; আর সেটি হলো কীভাবে জনসংখ্যার প্রায়-স্থিরতা বজায় রাখা যায়। আর যদি তারা তা শিখতে না পারে—আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে তারা শিখতে পারে এবং বহু মানুষ যেমনটা ভাবে তার চেয়ে অনেক দ্রুত শিখতে পারে—যদি তারা তা না পারে, তাহলে তারা তাদের সমতার দাবিটিতে বিজয় অর্জন করতে পারবে না।

রমনি: লর্ড রাসেল, আজকের দিনে আপনি কি অপরাপর দার্শনিকের চেয়ে কোন একজন নির্দিষ্ট দার্শনিকের অধিক প্রভাব দেখতে পান?

রাসেল: আপনি যদি কার্ল মার্ক্সকে একজন দার্শনিক হিসেবে সম্মান দিতে পারেন, তাহলে আমি মনে করি সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রভাবই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্যই অন্য কারো চেয়ে তার প্রভাব বেশি থেকেছে। এজন্যই আমি নিজে তাকে দার্শনিকের সম্মান খুব একটা দিতে না চাইলেও তাকে সেই তালিকায় রাখা উচিত বলে মনে করি।

রমনি: আমাদের মতো যারা মার্ক্সকে প্রত্যাখ্যান করে, আপনি কি আমাদেরকে একটি অধিক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জন্য কোন ধরনের ইতিবাচক দর্শনের সন্ধান দিতে পারেন?

রাসেল: আসলে এক্ষেত্রে আমি মনে করি, পৃথিবীতে অন্যতম একটি সমস্যা হলো কোন একটি বিষয়কে কট্টর বা গোঁড়াভাবে বিশ্বাস করা। আর আমি মনে করি এই সব বিষয়ই সন্দেহে পরিপূর্ণ এবং কোন যুক্তিবান মানুষই এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত হবে না যে সে সঠিক। আমি মনে করি আমাদের মতামতকে সবসময়ই কিছুটা সন্দেহের সাথে প্রকাশ বা লালন করা উচিত। এটি চাওয়া আমার উচিত হবে না যে মানুষ কোন একটি দর্শনকে কট্টরভাবে বিশ্বাস করবে, এমনকি আমার দর্শনকেও না, একেবারেই না। আমি মনে করি আমাদের উচিত আমাদের দর্শনগুলোকে কিছুটা সন্দেহের সাথেই গ্রহণ করা। আমি আসলে যা ভাবি তা হলো, যদি কোন দর্শন সুখ-সমৃদ্ধি আনতে চায় তাহলে তাকে মহৎ অনুভব দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হবে। মার্ক্স সে ধরনের অনুভব দ্বারা প্রভাবিত নয়। মার্ক্স দাবি করেছিল যে সে প্রোলেতারিয়েতের সুখ-সমৃদ্ধি চায়। কিন্তু আসলে সে চেয়েছিল বুর্জোয়াদের অ-সুখ। আর এটিই হলো সেই নেতিবাচক ও ঘৃণাপূর্ণ উপাদান যার কারণে তার দর্শন থেকে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। যে দর্শন ভালো কিছু করতে চায় তাকে অবশ্যই অনুপ্রাণিত হতে হবে মহৎ অনুভব দ্বারা, নিষ্ঠুরতা দ্বারা নয়।

রমনি: শেষ করছি এই প্রশ্নটি দিয়ে, আপনি কি মনে করেন আজকের বিশ্বের জন্য কোন ধরনের আশা-ভরসা রয়েছে?

রাসেল: দেখুন, আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি যে আশা-ভরসা রয়েছে। আমি খুবই দৃঢ়ভাবে এটি অনুভব করি, যদিও আমি জানি না এই অনুভব বাস্তবতার আলোকে কতটা যৌক্তিক, কিংবা কতটা মানসিক একটি অনুভব মাত্র। আমাদের সামনে হয়তো খুবই ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে, আমার তেমনটাই মনে হয়। কিন্তু তারপরও আমি খুবই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এসব ভয়ঙ্কর বিষয় থেকে উদ্ভূত যে কোন ধরনের বেদনা ও দুর্ভোগের পরও মানবজাতি এমন এক পৃথিবীর উদ্ভবের দিকে এগিয়ে যাবে, যা হবে অতীতের যে কোন পৃথিবীর চেয়ে সুখকর। এই ভাবনার সাথে আমি পুরোপুরি একমত, আমি শুধু জানি না যে এমনটা হতে আসলে কতটা সময়ের প্রয়োজন।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।