শিবলী নোমান
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষভাগে কোলকাতা শহরে বসবাস করা এক যুবকের কথা ভাবা যাক। ২৪ বছর বয়সী এই যুবকের মূল পরিচয় হলো তার অস্থিরতা আর কোলকাতা শহরের প্রতি তার বিতৃষ্ণা। এই বিতৃষ্ণার কারণ শুধুমাত্র কোলকাতা শহরের গরম, নোংরা পরিবেশ আর স্বার্থপর মানুষের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে বেশ বড় ভূমিকা পালন করছে যুবকটির রাজনৈতিক ভাবনা ও মতাদর্শিক অবস্থান।
কোলকাতার রাজ্য সরকারে তখন বামপন্থি তথা কমিউনিস্টদের প্রবল প্রতাপ। এদিকে আমাদের আলোচ্য যুবকটি ঘোর সাম্যবাদবিরোধী। তার চোখে সাম্যবাদ মানে ক্ষমতার শৃঙ্খলে সাধারণ মানুষের আটকে থাকার ভিন্ন এক পন্থা, যা ইতিহাসের নানা সময়ে নানা অঞ্চলে কেবলমাত্র স্বৈরশাসনেরই জন্ম দিয়েছে। তার চেয়ে সে বরং নিজেকে পরিচয় দেয় অস্তিত্ববাদী হিসেবে, তার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পশ্চিমা ধাঁচের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে।
অর্থাভাবগ্রস্ত, বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক এই যুবকটি অভিনয় করতে চায়। নিজের একটি থিয়েটার দলও রয়েছে। তবে কোলকাতার বাণিজ্যিক বাংলা চলচ্চিত্রকে অখাদ্য ও বস্তাপচা ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে মানতে সে নারাজ। কোলকাতা শহরটাকেও বড় দূরের মনে হওয়ায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের পূন্যভূমি পাশ্চাত্যে থিতু হওয়ার দিকেই তার মূল ঝোঁক। অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের কর্মকর্তার সাথে পরিচয়ের সুবাদে সে তাই তক্কে তক্কে আছে কোন কায়দা করে যদি পশ্চিম জার্মানি অংশের বার্লিনের কোন থিয়েটার কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে একদিকে অভিনয় জগতেও থাকা হলো, আবার কোলকাতা শহরটা থেকেও মুক্তি মিললো।
এসবের মাঝেই প্রায় হুট করেই সংক্ষিপ্ত এক পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে কোলকাতার এক নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক যুবকটিকে তার পরবর্তী চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, যুবকটি সেই প্রস্তাব গ্রহণও করে। যদিও রাজি হওয়ার পেছনের কারণটি যুবক নিজেও জানে না।
তো, এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে এই যুবক ও সেই চলচ্চিত্র পরিচালকের ভেতর সম্পর্কের যে ঘাত-প্রতিঘাত ও তার ফলশ্রুতিতে দারুণ ও দীর্ঘস্থায়ী এক রসায়ন তৈরি হয়, তারই বয়ান আমরা দেখতে পাই সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া অঞ্জন দত্ত পরিচালিত চলচ্চিত্র চালচিত্র এখন-এ। আলোচিত সেই যুবকটি অঞ্জন দত্ত নিজেই, আর পরিচালকটি হলেন মৃণাল সেন। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া চালচিত্র চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়েই অঞ্জন ও মৃণালের এই রসায়নের শুরু।
চালচিত্র এখন চলচ্চিত্রটির কাহিনীকে অসাধারণ বলার সুযোগ খুব কম। কোন কোন অর্থে একে হয়তো চলচ্চিত্র বলাও মুশকিল হতে পারে। এ তো আসলে মৃণাল সেনকে নিয়ে অঞ্জন দত্তের একেবারেই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, অথবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে চালচিত্র-তে কাজ করতে গিয়ে অঞ্জনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর মৃণাল সেনকে নিয়ে অঞ্জনের ভেতর তৈরি হওয়া মনোভাবের এক পুনঃপ্রচার। এ কারণেই অঞ্জনের চরিত্রে রঞ্জন আর মৃণাল সেনের চরিত্রে কুনাল সেনের বাইরে এই চলচ্চিত্রের অন্যান্য চরিত্রগুলোকে খুব বেশি চোখেও লাগে না। তবে অঞ্জন এই দাবিও করেছেন যে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে এসে বৃহৎ ক্যানভাসে মৃনালকে দেখতে সক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত এই চলচ্চিত্র নির্মাণ তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল।
যাই হোক, খুব সাধারণ ও অনেক অর্থেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর এই চলচ্চিত্রের পরতে পরতে যে জীবন দর্শন ছড়িয়ে আছে তার মূল্য হাকানোর সুযোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব। তাছাড়া অঞ্জন দত্ত তাঁর কাজের মাধ্যমে এখনও এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, এই চলচ্চিত্রখানা দেখতেই হয়। আর দেখার পর রাজনীতি ও ইতিহাস সচেতন সাধারণ দর্শকের ভেতর তৈরি হওয়া মুগ্ধতাই শুধু নয়, মানুষের জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা দর্শন কীভাবে আরেকজনের ভেতর সঞ্চারিত করতে হয়, অঞ্জন আর মৃণাল কীভাবে এই কাজটি করেছিলেন একে অপরের সাথে, তার উপস্থাপন ভঙ্গিতে দর্শকের মনে হতেই পারে এই সম্পর্কের রসায়ন যেন তারাও খুব কাছে থেকে দেখছেন।
অঞ্জন দত্তকে আমরা চিনি কোলকাতা শহর নিয়ে তাঁর লেখা ও গাওয়া গান এবং নির্মিত ও অভিনীত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। কোলকাতা শহরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যেভাবে তাঁর গানে স্থান করে নেয়, তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে একসময় এই কোলকাতা শহরের প্রতিই নিদারুণ এক বিতৃষ্ণা অনুভব করেছেন অঞ্জন নিজেই। দিনের পর দিন চেয়েছেন এই শহরটা ছেড়ে চলে যেতে। অথচ মৃণাল সেনের সাথে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দিনের পর দিন কোলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে, চলচ্চিত্রের শ্যুটিং শেষ হতে হতে তার আর শহরটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। যে কোন ভাবেই হোক, তিনি থেকে যেতে চাচ্ছেন মৃণালের সাথে, সেজন্যই দাঁত-মুখ খিচিয়ে যুবক অঞ্জনও বলছে মৃণালের প্রিয় কোলকাতা শহরটাকে তাঁরও ‘দারুণ’ লাগছে।
কিন্তু অঞ্জনের মনে তখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সে কোন ধরনের সমঝোতায় রাজি নয়। মৃণালের সাথে থেকে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও তার পক্ষে কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। স্তালিন, মাও সে তুং, কম্বোডিয়ার খেমা রুজ, হিটলারের গ্যাস চেম্বার, সোভিয়েত গুলাগ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়েই সে মৃণালকে কথাও শুনিয়ে দেয় প্রায়শই, আবার ঠিক এর পরেই এভাবে কথা বলার জন্য ক্ষমাও চায়। এ কারণেই অঞ্জন হয়তো আজও জানেন না তাঁর জীবনে পিতার চেয়ে বেশি অবদান রাখা মৃণাল সেনের সাথে তাঁর সম্পর্কটা আসলে কেমন, বন্ধুসম, পিতৃসম, নাকি গুরু-শিষ্যের?
এই চলচ্চিত্রে কাজ করতে এসেই মৃণালের প্রতি এক অদ্ভুত টান বোধ করতে শুরু করেন অঞ্জন। একই কাজের জন্য কখনো প্রশংসা করা, আবার কখনো বিশ্রীভাবে বকার জন্য যে মানুষটাকে অঞ্জন একেবারেই নিতে পারেন না, তাঁর প্রতিই আবার এরকম ভালোবাসার কোন কারণ আবিষ্কার করতে পারাও নেহায়েত কঠিন এক কাজ। আবার মৃণালও বলছেন তাঁর সাথে থাকার জন্য অঞ্জনের কমিউনিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ অঞ্জনকে কাজ দেয়া হয়েছিল তাঁর অভিনয় দক্ষতা দেখে, মতাদর্শ নয়। অর্থাৎ কেন মানুষ এমন সব মানুষের সাথে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়, যাদের সাথে তাদের মতাদর্শগত কোন মিল নেই? কারণ, মতাদর্শ মানুষের জীবনের অনেকগুলো চলকের ভেতর একটি মাত্র, একমাত্র তো নয়।
আর মৃণালও সুযোগ পেলেই অঞ্জনকে বুঝিয়ে দেন সকল মানুষেরই জীবন সংগ্রাম আছে, যার যার মতো করে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে তিনি অঞ্জনের বন্ধ হয়ে যাওয়া নাটকের সংলাপ ধার করেই বলেন,
নিজেকে নিজের চুল ধরে হেচড়ে টেনে দাঁড় করানো
নিজেকে নিজে ওলোট-পালোট ঝাঁকানো
তারপর গোটা পৃথিবীটাকে একটা তরতাজা দৃষ্টিতে দেখা
দিনশেষে চালচিত্র এখন আরেকবার দেখিয়ে যায় মাত্র একজন মানুষ কীভাবে অন্য একজন মানুষের জীবনটাকে বদলে দিতে পারে। মৃণাল সেনের কারণেই অঞ্জন দত্ত হতে পেরেছেন কোলকাতার অঞ্জন দত্ত, গায়ক ও নায়ক; জীবনের নানা দর্শনও খুঁজে পেয়েছেন মৃণাল সেনের আশেপাশের মানুষগুলো থেকে। আর মৃণালের জন্মশতবার্ষিকীতে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে অঞ্জনও দেখিয়ে দিলেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে গুরুকে দেবতা হিসেবে নয়, মাটির মানুষ হিসেবে কীভাবে স্থাপন করা যায় এই ধরায় ও মানুষের হৃদয়ে, তাঁর প্রতি পূর্ণ সম্মান ও ভালোবাসা অটুট রেখেই।