শিবলী নোমান
এডওয়ার্ড ওয়াদি সাঈদ আমাদের এই অঞ্চলে বেশ পরিচিত এক নাম। আমজনতার মুখে মুখে উনার নাম ঘুরে না বেড়ালেও অন্তত সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা-মানবিকী বিষয়ক বিদ্যায়তনের অংশীজনদের মুখে মুখে সাঈদের নাম ঘুরে বেড়ায় প্রায় নিত্যদিন। ধারণা করা যেতেই পারে যে, ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম শীর্ষক গ্রন্থের জন্যই এতদঞ্চলে উনার এমনতর খ্যাতি; কিংবা কে জানে, কোন কোন ক্ষেত্রে কুখ্যাতিই কিনা! তো অরিয়েন্টালিজম-ই এডওয়ার্ড সাঈদের শ্রেষ্ঠ কাজ, এমনতর দাবি উত্থাপন না করে, অথবা অহেতুক এ ধরনের বিতর্কে না গিয়ে এটুকু হয়তো বলাই যায় যে, এডওয়ার্ড সাঈদ গত শতকের ও সমসাময়িক বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ একজন বুদ্ধিজীবী। তো, সাঈদের একটি দারুণ আগ্রহোদ্দীপক আলোকচিত্র অন্তর্জাল বা ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায়। কাকতাল হলেও সত্য যে, এই লেখায় যে বইটি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতেও সাঈদের সেই আলোকচিত্রটি স্থান পেয়েছে। উল্লিখিত আলোকচিত্রটিতে দেখা যায়, লেবানন সীমান্ত থেকে ইসরায়েলের দিকে পাথর ছুড়ে মারছেন এডওয়ার্ড ওয়াদি সাঈদ। বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার সীমানা ছাপিয়ে এই যে সাঈদের পাথর ছুড়ে মারার ‘অ্যক্টিভিজম’, সেখান থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে যে, বুদ্ধিজীবীর কাজ আসলে কী? তিনি কি জীবন ও সমাজকে ব্যাখ্যার নামে শুধুমাত্র তত্ত্বকথাই আউড়ে বেড়াবেন? নাকি সময়ে সময়ে পাথর ছুড়ে মারার কাজটিও তাকে করতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইলে কিংবা না চাইলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির মুখোমুখি তো হতেই হয়, আর তা হলো এই বুদ্ধিজীবী আসলে কাকে বলবো? কোথায় পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবীকে?
বুদ্ধিজীবী আমাদের আশেপাশেই আছে, কিংবা এই লেখার পাঠকমাত্রই বুদ্ধিজীবী হতেই পারেন। কিন্তু যে প্রচলিত চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা ঠিক করি অমুক একজন বুদ্ধিজীবী, কিংবা তমুকের বুদ্ধিজীবী হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নাই—অর্থাৎ বক্তির পেশাগত পরিচয় যদি তার বুদ্ধিজীবীতার মাপকাঠি বা নির্ধারক হয়ে ওঠে তাহলে এই কায়দায় বুদ্ধিজীবীর নির্দিষ্টকরণ সমস্যাক্লিষ্ট বটে। কারণ মানুষের পেশাগত পরিচয় তাকে যতটা সহজ ও স্বাভাবিকভাবে পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত করাতে পারে, সেই একই পেশার জন্য তাকে পেশাজীবীর সাথে বুদ্ধিজীবী বলা হলে বিষয়টা তো অনেকটা একই কৃতিত্বের জন্য দুইবার পুরষ্কার পাওয়ার মতো শোনায়। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গৌতম ভদ্র বলতে চান ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি দিয়ে আসলে আমরা যা বুঝাতে চাই, এই শব্দ দিয়ে তা বুঝানো আসলে নানা দিক থেকেই সমস্যায় পূর্ণ। ভদ্রের ভাষ্যানুযায়ী, সকল মানুষই বুদ্ধিজীবী কারণ যে মানুষটি কোন না কোন কাজ করে, তার বুদ্ধি থাকা বাঞ্ছনীয়। একই সাথে ভদ্র নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য এও বলে দিচ্ছেন যে, আমরা যাকে বুদ্ধিজীবী বলছি, তাকে আসলে বলা উচিত ‘মেধাজীবী’। কারন তাঁর মতে একজন মানুষ যখন তার বুদ্ধির সাথে দার্শনিক দৃষ্টভঙ্গি বা প্রজ্ঞাকে যুক্ত করতে পারেন, তখনই তিনি পরিণত হন মেধাজীবীতে, যাকে আমরা বুদ্ধিজীবী বলে আসছি।
তবে দুইটি বাক্যে কাকে বুদ্ধিজীবী বলা যাবে বা যাবে না, এমন একটি অবস্থায় যাওয়া আদতে অসম্ভব। গৌতম ভদ্রও তা করার চেষ্টা করেন নি। বুদ্ধিজীবী কিংবা মেধাজীবী নিয়ে তাঁর ভাবনা বা বোঝাপড়ার কিছুটা বুঝতে পারা যায় বুদ্ধিজীবী কারে কয় শীর্ষক গ্রন্থটি থেকে। মূলত ২০১৫ সালে কোলকাতার মাসিক আরম্ভ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য গৌতম ভদ্রের নেয়া একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে এই গ্রন্থটি করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের বড় অংশ জুড়ে থাকা বুদ্ধিজীবী ও এই সংক্রান্ত আলোচনাকে উপলক্ষ্য করেই সম্ভবত আলোচ্য বইটির শিরোনামে বুদ্ধিজীবী ও বুদ্ধিজীবীতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। মাসিক আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক বাহারউদ্দিনের নেয়া গৌতম ভদ্রের সাক্ষাৎকারটির পাশাপাশি এই বইতে আ-আল মামুনের লেখা বুদ্ধিজীবী সংক্রান্ত একটি বিষদ ভূমিকা ও ২০০৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিকল্পের রূপান্তর বা প্যারাডাইম শিফট বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে দেয়া গৌতম ভদ্রের একটি বক্তৃতাও এতে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া যুক্ত হয়েছে এসব বিষয়ে গৌতম ভদ্রের সাম্প্রতিক ভাবনা, বোঝাপড়া ও চিন্তা উদ্রেককারী মন্তব্যসমূহ ও আলোচনা।
কিন্তু কথা হলো, বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিজীবীতা নিয়ে আলোচনা তো কোন নতুন আলোচনা নয়, বরং বিদ্যায়তনের ভেতরে বা বাইরে এই বিষয়ে চর্চা বা আলোচনা অনেক সময়ই চর্বিত চর্বণ বলেও মনে হয় বৈকি। তাহলে কোন দিক থেকে গৌতম ভদ্রের মেধাজীবী, কিংবা বুদ্ধিজীবী নিয়ে গৌতম ভদ্রের আলোচনা স্বতন্ত্র? মূল বই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ও একই সাথে মূল বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ না কমিয়ে শুধুমাত্র এটুকুই এখানে বলার সুযোগ আছে যে, এডওয়ার্ড সাঈদ যেখানে তাঁর রিপ্রেজেন্টেশনস অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল গ্রন্থে বা বক্তৃতাগুলোতে জুলিয়ান বেন্দা ও আন্তোনিও গ্রামসির বুদ্ধিজীবী সংক্রান্ত আলোচনার সঙ্কটগুলো দেখিয়ে দিয়ে পাবলিক বা জনবুদ্ধিজীবীর ধারণাকে সামনে এনেছেন এবং আমাদের অঞ্চলের সেক্যুলার কিংবা তথাকথিত সেক্যুলার সমাজের প্রশংসা কুড়িয়েছেন, সেখানে সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের গৌতম ভদ্র বুদ্ধিজীবী নিয়ে সাঈদের আলোচনার সেক্যুলার বৈষিষ্ট্য বা অংশটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেই মেধাজীবীকে নিয়ে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। আরো সহজ করে বললে ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে সমাজের প্রতিটি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মুখে যাই বলা হোক না কেন, তার পেছনে ঐ সমাজের ধর্মচর্চার ভূমিকাকে ভদ্র গুরুত্বের সাথে বিচার করার পক্ষেই রায় দিয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীতা নিয়ে ভদ্রের এই সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, আরজ আলী মাতুব্বরকে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নীরদ সি. চৌধুরীও, ভদ্রের মতে যারা ‘গোঁড়া’ তথা রক্ষণশীল। আবার রক্ষণশীলতা সমাজে কীভাবে ভূমিকা তথা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে সে সম্পর্কেও তাঁর অভিনব ব্যাখ্যা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যাবে এই সাক্ষাৎকার তথা বইটিতে।
তবে বুদ্ধিজীবীর সন্ধান বা অনুসন্ধান যে একটি চিরস্থায়ী চলমান প্রক্রিয়া, সেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভদ্রর ব্যাখ্যাতেও স্পষ্ট। আর সম্ভবত এটিই বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত পরিচয়। একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী সবসময়ই তার লক্ষ্য দেখতে পান, লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর দেখেন লক্ষ্য দূরে সরে গেছে। তখন শুরু হয় নতুন সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বুদ্ধিজীবীর নতুন কর্মপন্থা। তাই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বুদ্ধিজীবীকে হয়তো পাথর ছুড়ে মারতেও হতে পারে। আদতে তাহলেই বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতে পারেন ফিলোসফি অব প্র্যাক্সিস-এর প্রকৃত চর্চাকারী। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থা বা ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে যে বুদ্ধিজীবী অবস্থান করে, তার বা তাদের জন্য নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর একটি কথাই যথার্থ। লেখকদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৮৫ সালে থিয়োঙ্গো বলেছিলেন, চুপ হয়ে গিয়ে কিংবা সেলফ-সেন্সরের মাধ্যমে নিজেকে গুটিয়ে রেখে, অথবা বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর পক্ষে লেখার মাধ্যমে একজন লেখক আদতে তার লেখক সত্তা হারায়। একজন বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি যে একই, অর্থাৎ জীবন ও সমাজকে সুবিধাজনকভাবে ব্যাখ্যার জন্য তত্ত্বকথা আউড়ে বেড়ানোই যে বুদ্ধিজীবীতা নয়; বরং জীবনের তত্ত্ব খুঁজে বেড়ানো, প্রয়োজনে সেই খোঁজ করতে গিয়ে মৃত্যুকে খুঁজে পাওয়াই হয়তো একজন মানুষের বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার লক্ষণ—পাঠক হয়তো বুদ্ধিজীবী নিয়ে ভদ্রের আলোচনায় সেই ছাপ খুঁজে পাবেন।
(রচনাকাল: জানুয়ারি, ২০২২)