শিবলী নোমান

হারারির হোমো ডিউস: আদৌ কি মানুষের ভাবীকাল?

শিবলী নোমান

ইসরায়েলের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি নিঃসন্দেহেই বর্তমান সময়ের একজন আলোচিত লেখক। তাঁর প্রথম গ্রন্থ Sapiens: A brief history of humankind ২০১১ সালে হিব্রু ভাষায় প্রকাশিত হয়। বইটি ২০১৪ সালে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হওয়ার পরই মূলত হারারি ও তঁর এই বই ব্যাপক পরিচিতি পায়। কিছুদিন আগে বইটি অনূদিত হয়েছে বাংলা ভাষাতেও ।

স্যাপিয়েন্স-এ হারারি মূলত পৃথিবীতে মানুষের প্রায় ৭০ হাজার বছরের ইতিহাসকে প্রচলিত আখ্যানের বাইরে বেরিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ৬০ হাজার বছর আগের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, ১২ হাজার বছর আগের কৃষি বিপ্লব ও ৫০০ বছর আগে সংঘটিত বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের আলোকে। স্যাপিয়েন্সের শেষে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, এই যে পৃথিবীতে ৭০ হাজার বছরের পরিক্রমায় আমাদের তথা হোমো স্যাপিয়েন্সের পৃথিবীর নিয়ন্তা হয়ে ওঠা, এরই ফল হিসেবে সামনের সময়ে মানুষ এক লক্ষ্যহীন প্রাণিতে পরিণত হতে পারে, যে জানে তার হাতে রয়েছে অসীম ক্ষমতা, কিন্তু সে এটি জানে না যে এই ক্ষমতাকে সে কেন ও কিভাবে ব্যবহার করবে।

২০১৫ সালে হিব্রু ও ২০১৬ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় হারারির দ্বিতীয় বই Homo deus: A brief history of tomorrow। এই বইটিকে মূলগত দিক থেকে স্যাপিয়েন্সের দ্বিতীয় খণ্ডও বলা যেতে পারে। স্যাপিয়েন্স যেখান থেকে শেষ হয়েছিল তার কিছুটা আগে থেকে, কিংবা অন্যভাবে বললে স্যাপিয়েন্সে উল্লিখিত অনেক বিষয়ের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়েই হোমো ডিউস এগিয়ে গিয়েছে। তবে স্যাপিয়েন্স পড়ার ফলে হারারির লেখার উদ্দেশ্যকে মানব সভ্যতার সরল ও সাবলীল ইতিহাস আখ্যান মনে হলেও, হোমো ডিউসে এসে অন্য এক হারারিকে পাঠক আবিষ্কার করলেও করতে পারেন।

স্যাপিয়েন্সের শেষ দিকে ও হোমো ডিউসের প্রথম দিকে হারারি দাবি করছেন বর্তমান সময়ের পৃথিবীতে মানুষ War, plague and famine তথা যুদ্ধ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষকে জয় করেছে। বিগত সময়ের ইতিহাস থেকে পরিসংখ্যানের দোহাই দিয়ে হারারি বলতে চান যে, অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় এই তিন বিপর্যয়ে মানুষের প্রাণহানি বা ক্ষতির পরিমাণ বর্তমানে অনেক কম।

এক্ষেত্রে হারারি যদি ইউরোপের কথা ভেবে এই ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন তাহলে অভিযোগের কিছু থাকে না। কারণ খোদ ইউরোপের কাছেই প্রকৃত ইউরোপ মানে পশ্চিম ইউরোপ, এমন ধারণা হরহামেশাই পাওয়া যায়। আর পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি কোন ধরনের যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষ অন্তত ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখা যায় নি। কিন্তু হারারি যদি অন্তত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কথা, বলকান এলাকা, আফগানিস্তান কিংবা কিছুদিন আগে পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার সংকট আমলে না আনেন, তাহলে তার এই ব্যাখ্যা থেকে তিনি পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের মানুষদের খারিজ করে দিয়েছেন কিনা, তা নিয়ে ভুরুটা একটু কুঁচকানোই যায় বটে।

আর ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করা করোনা ভাইরাস কিংবা কোভিড-১৯ এর বিস্তার ও এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হারারির প্রস্তাবনাকে কিছুটা হলেও থমকে দিয়েছে, এমনটা বলাই যায়।

যুদ্ধ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষকে জয় করে ফেলার প্রাথমিক প্রস্তাবনার পর হারারি বলতে চান, এই সময়ে এসে মানুষের মূল লক্ষ্য হলো Happiness বা সুখ ও Immortality বা অমরত্ব অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর এই দুই বিষয় অর্জনের মাধ্যমে মানুষ মূলত ঈশ্বরে পরিণত হবে বলেও মনে করছেন হারারি। ঈশ্বর হতে পারা যদি মানুষের আজন্মলালিত fantasy কিংবা কোন কোন অর্থে complex হয়েও থাকে, এই ঈশ্বরত্ব অর্জনের পথে হারারির যে প্রস্তাবনা তাকে এক কথায় গ্রহণ বা বর্জন, কোনটা করাই সহজ মনে হয় না।

এক্ষেত্রে প্রথমেই হারারি আমাদেরকে এটি বিশ্বাস করাতে চান যে, আমাদের যে সুখ, দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ বা অভিমান, তথা আমাদের যেসব মানবিক অনুভূতি নিয়ে আমরা নানা ধরনের শ্লাঘায় ভুগে থাকি, সেগুলো আসলে কিছুই নয় বরং আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ইলেকট্রিক তাড়নার মতো, হারারির ভাষায় যা নিছকই এক sensation মাত্র। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে হারারি তার পরবর্তী ব্যাখ্যাকে ভিত্তি দেয়ার জমিন তৈরি করে নিয়েছেন কিনা তা সচেতন পাঠক ভেবে দেখতে পারেন, যে ভবিষ্যতে মানুষকে মূলত যন্ত্রের হাতে তুলে দিতে চান হারারি।

মানুষের সুখ ও অমরত্ব অর্জনের পথ মানেই হলো মানুষের জীবনকে সহজ করে ফেলার পথ। ৭০ হাজার বছর ধরে বিবর্তন ও হাড়ভাঙা পরিশ্রমের যে সিলসিলার ভেতর দিয়ে মানব প্রজাতি উঠে এসেছে, সেই পরিশ্রম থেকে চিরমুক্তি পেয়ে অমরত্ব কিংবা ঈশ্বরত্ব পেতে গিয়ে আমাদের সমাজে বর্তমান সময়েও চলমান অনেকগুলো পেশা খুব স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন হারারি। এক্ষেত্রে এসব পেশার মানুষের জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence ব্যবহার করে আরো বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী পথে এগিয়ে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করছেন তিনি। আর এরই ফল হিসেবে তিনি এও উল্লেখ করছেন যে, এর ফলে প্রচুর মানুষ তাদের জীবিকা হারাবে, কারণ তাদের বিশেষত্ব ও দক্ষতা তৈরি হওয়া পেশাগুলোই আর মানুষের জন্য অস্তিত্বশীল থাকবে না। ফলে তারা পরিণত হবে এক ধরনের ব্যবহারমূল্যহীন শ্রেণিতে। হারারি নিজেই বলছেন এর ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়বে। এক্ষেত্রে তাহলে প্রশ্ন এসেই যায়, মানুষকে অমর ও ঈশ্বরে পরিণত করার যে ভবিষ্যত হারারি আমাদের দেখান সেখানে কি একটি বিশেষ শ্রেণি তথা ধনিক শ্রেণিই ঈশ্বরে পরিণত হতে যাচ্ছে? আর এই খণ্ডিত অংশের ব্যাপক ক্ষমতা পাওয়াকেই কি হারারি বলতে চাচ্ছেন মানুষের অমরত্ব ও ঈশ্বরত্ব অর্জন? সেক্ষেত্রে এই অর্জনের পেছনে গোটা মানব সম্প্রদায়ের খরচটা কি বড় বেশি হয়ে যায় না?

এ পর্যন্ত হারাই যে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করেন তাকে পাঠক নিজের মেনে নেয়া বা না নেয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নিতান্তই একজন ব্যক্তি হিসেবে পাঠকের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে মানুষের এই অসীম সুখ, অমরত্ব ও ঈশ্বরত্ব অর্জনের বিষয়টিকে হারারি শুধুমাত্র অনুমানের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখেন নি, বরং যেহেতু তাঁর বইয়ের উপশিরোনামই হলো ভাবী কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, তাই তিনি এর পথ-পরিক্রিমাও বলার চেষ্টা করেছেন।

২.

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসা ইতোমধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে কিংবা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মগুলোর গোবেচারা ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের খুব কম অংশই জানতে পারছি যে, এসব প্লাটফর্ম ও ডিভাইস ব্যবহারের বিনিময়ে আমরা আমাদের সব তথ্যের সাথে সাথে আমাদের নিজেদেরকেও গুগল, ফেইসবুকের মতো গোষ্ঠীগুলোর কাছে সঁপে দিচ্ছি। আর এই যে সঁপে দেয়া, তা সম্ভব করছে এসব গোষ্ঠীর অ্যালগরিদম। এক্ষেত্রে সচেতন মানুষদের একাংশ এসব মুনাফামুখী, আগ্রাসী মাধ্যম ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। কিন্তু সাধারণ মানুষ জীবনকে সহজ করার অতিসহজ পথ হিসেবে এগুলো ব্যবহার করছেই এবং তা করাই স্বাভাবিক। আর এর ফলেই আমাদের আর মার্কেজের বলে যাওয়া Private ও Secret Life বলে কিছু থাকছে না, সবই হয়ে যাচ্ছে Public বা প্রকাশ্য জীবনের অংশ। দুই সপ্তাহ আগে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন তা আপনার মনে নাই থাকতে পারে, কিন্তু আপনার হাতের ডিভাইসের তা নিশ্চিতভাবেই জানা আছে। আর এই ডিভাইসে থাকা তথ্য ব্যবহার করে আমাদেরকে আমাদের চেয়েও বেশি চিনে ফেলছে গুগলের মতো এই গোষ্ঠীগুলো। আমরা পরিণত হচ্ছি এদের হাতের পুতুলে। মূলত নব্য-উদারবাদী পুঁজিবাদের নতুন মঞ্চে পরিণত হয়েছে ভার্চুয়াল জগত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শশানা জুবোফ এই নতুন ধরনের পুঁজিবাদকে Surveillance Capitalism বা নজরদারিমূলক পুঁজিবাদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

আলোচনা কিছুটা অন্যদিকে সরে গেছে মনে হলেও হারারির আলোচনাই কেন্দ্রে রয়েছে। কারণ হারারি বলতে চান যে, আগের মতো কষ্টকর জীবন যাপন না করে, নিজের মস্তিষ্কে অত্যাধিক তথ্যের চাপ না দিয়ে মানুষের উচিত হবে এসব কর্পোরেশনের সাহায্য নিয়ে নিজের জীবনকে সহজ করে ফেলা। এক্ষেত্রে হোমো ডিউসে হারারি যেসব উদাহরণ ব্যবহার করে এসব কর্পোরেশনের পক্ষে ওকালতি করেছেন, সেগুলো খুব মুখরোচক হলেও হারারি একবারও এই সুবিধার বিনিময়ে এসব কর্পোরেশনের কাছে মানুষের বেপর্দা হয়ে যাওয়া নিয়ে কিছু বলেন নি। এটি নিয়ে তাই সন্দেহ দেখা দেয় যে, হারারি মানুষের ভবিষ্যত বর্ণনা করতে গিয়ে গুগল, ফেইসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানের নজরদারিকে বৈধতা দেয়ার প্রকল্প গ্রহণ করেছেন কিনা।

তবে হোমো ডিউসে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে অনস্থানটি হারারি গ্রহণ করেছেন তা হলো, তিনি মানবিকতা বা Humanity-কে খারিজ করে দিচ্ছেন বা তামাদি ঘোষণা করছেন। স্যাপিয়েন্সে যেখানে হারারি বলেছিলেন যে ৫০০ বছর আগে সংঘটিত বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলেই দারুণ গতিতে মানুষের অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল; হারারি তাঁর হোমো ডিউসে সেই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অন্যতম উপজাত মানবিকতার মৃত্যু ঘোষণা করেছেন। হারারি বলতে চান আগামী দিনগুলোতে মানবিকতার খুব বড় কোন ভূমিকা থাকবে না। বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদমের মাধ্যমে Data বা তথ্য পরিণত হতে যাচ্ছে নতুন এক ধর্মে। আর এসময় ডাটা বা তথ্য যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, মানব সভ্যতা তথা পৃথিবীর নিয়ন্তাও হবে সেই। আর এই পরিক্রমায় মানুষ মূলত আর স্যাপিয়েন্স নয় বরং অন্য কিছুতে পরিণত হবে।

৩.

মানবিকতাহীন একটি পৃথিবীর কথা চিন্তা করে দেখা তাই হোমো ডিউসের প্রতিটি সচেতন পাঠকের দায়িত্বের ভেতর পড়ে। গত ৫০০ বছর ধরে মানবিকতার অনুপস্থিতিতে মানব সভ্যতার কোন অর্জনটি সাধিত হয়েছে তা নিয়ে ভাবাও খুব জরুরি হয়ে যাবে সামনের সময়গুলোতে। গুগল, ফেইসবুকের মতো বিভিন্ন কর্পোরেশনের যে আগ্রাসী আধিপত্য বা জয়-জয়কারের ভবিষ্যত হারারি বর্ণনা করেছেন, তা হয়তো কোন অর্থেই ভুল বা বিভ্রান্তিকর নয় বরং প্রকৃত অর্থেই তা আমাদের ভবিষ্যত বা বাস্তবতা; কিন্তু হারারি যেভাবে আমাদেরকে কর্পোরেশনগুলোর কাছে নিজেদেরকে সমর্পনের কথা বলেন, নিঃশর্তভাবে তা মেনে নিলে মানব জাতির বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হবে বলে মনে করার কোন কারণ অন্তত আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না।

তাই হোমো ডিউসের প্রতিটি সচেতন মানবিকতাবাদী পাঠককে বারংবার বলতেই হবে, হোমো ডিউসে হারারি মানুষের যে ভাবী কাল বর্ণনা করেছেন, সেই ভাবী কাল মানুষের নয় আর তাই মানুষ তা চায় না। মানবিকতাহীন ভাবী কালে মানুষের অবস্থানই যেখানে ঠুনকো, সেখানে মানুষের দ্বারা পৃথিবীত তাবত সকলের কল্যাণ কোনভাবেই আশা কর যায় না।

আর তাই শেষ বিচারে, হোমো ডিউসের লেখক হিসেবে হারারিকে পশ্চিমা ধাঁচের একচেটিয়া পুঁজিবাদের পক্ষপাতী গুগল, ফেইসবুকের মতো কর্পোরেশনগুলোর আধিপত্য অর্জনের পথে মানব মসীহা বলা গেলেও, মানুষের ভাবী কালের বর্ণনাকারী হিসেবে মেনে নেয়া বড়ই প্রশ্নসাপেক্ষ ও বিতর্কের বিষয় হিসেবে থেকে যায় বটে।

(রচনাকাল: এপ্রিল, ২০২১)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।